নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে এখনো কার্যকর উদ্যোগে পিছিয়ে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। এক্ষেত্রে অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যাংকের অবদান মাত্র ২৩ শতাংশ। সেখানে অর্ধেকের বেশি আসছে উচ্চসুদের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ঋণ। এছাড়া পরিবার ও ব্যক্তিনির্ভরতার মাধ্যমে আসছে অর্থায়নের বড় অংশ। ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রেই এ ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস ও ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়ন টেকসই হতে বাধাগ্রস্ত করছে।
সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক দেশের নারীদের উদ্যোক্তা তৈরি পরিস্থিতি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের ওপর গবেষণা কার্যক্রম চালায়। ‘সিচুয়েশন অব উইমেন সিএএসএমই এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যান্ড ইনফরমাল সেক্টর ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের আটটি বিভাগের ২৮ জেলায় প্রায় ১ হাজার ৫৮৯ জন নারী উদ্যোক্তা ও শ্রমিকের ওপর জরিপ কার্য পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় ১০ খাতের উদ্যোক্তাদের মতামত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, কৃষি, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি/ইলেকট্রনিকস/সফটওয়্যার, পাট ও হ্যান্ডিক্রাফটস, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন বিজনেস।
গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। সেখানে অর্থায়নের উৎস হিসেবে এনজিওগুলোর অবদান ৪৯ শতাংশ। এর পরই ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে আসছে ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ, পারিবারিক উৎস থেকে ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যাংকের সাধারণ ঋণের খাত থেকে নারীদের চাহিদা পূরণ হচ্ছে ১৩ শতাংশ এবং ব্যাংকের নারী উদ্যোক্তা ঋণ খাত থেকে আসছে আরো প্রায় ১০ শতাংশ। ফলে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংকের অর্থায়ন অবদান মাত্র ২৩ শতাংশ। পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে আসছে ১০ শতাংশ। অন্যান্য ব্যবসায়িক খাত বা আয়ের উৎস থেকে ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য খাত থেকে আসছে প্রায় ১ শতাংশ অর্থায়ন।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর প্রত্যেকটি শাখাকে নতুন নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ক্ষেত্রে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়ার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। তবে সেসব সুযোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংকিং খাত জনপ্রিয় হয়নি।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর অর্থায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা হলো মাঝারি উদ্যোগ। তবে কটেজ ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে অর্থায়ন খুবই কম। ফলে ছোট এসব ব্যবসা করার ক্ষেত্রে উচ্চসুদে ঋণ ও পারিবারিক উেসর ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব ব্যবসা টেকসই করাটাও কষ্টকর হয়, যার প্রভাব দেখা গেছে করোনাকালে। অনেকের ব্যবসা বন্ধ রাখতে হয়েছে কিংবা কোনো ধরনের আয় ছিল না। ফলে তারা অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব নারী শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাদের জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়া দরকার। কারণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে ব্যাংক এক্ষেত্রে জামানত হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। নারীরা যদি উদ্যোক্তা হয়, তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজ হবে। নারীরা সাধারণত বাসায় থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করতে পছন্দ করেন। এ কারণে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। লাইসেন্স নিতে হয়রানির কারণে
অনেক নারী ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নারীদের ঋণ ও ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ করা দরকার।
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে জনতা ব্যাংকের সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যে মাত্রায় নারী উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ যাচ্ছে, সেটি মোটেও প্রত্যাশিত নয়। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে এখনো ব্যাংকগুলো সেভাবে এগিয়ে আসছে না। এজন্য সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থায়ন সুযোগ বৃদ্ধি করছি।
জানা গেছে, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গড়ে ৮-১০ লাখ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। এসব ঋণের মধ্যে নারীরা পান মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি। নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর নেতিবাচক মনোভাব বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার চাপের কারণে ব্যাংকাররা দায়সারাভাবে নারীদের কিছু ঋণ দেন। নানা শর্তের বেড়াজাল ও হয়রানির কারণে নারীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ভয় পান। বড় ঋণ না পাওয়ায় আধুনিকতার এ যুগেও নারীরা এসএমই খাতে সীমাবদ্ধ থাকছেন।
এ বিষয়ে উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ওয়েব) সভাপতি নাসরিন ফাতেমা আউয়াল বলেন, ব্যাংকগুলোর নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া বেশির ভাগ ঋণই পরিচিতজন কিংবা নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমেই দেয়া হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা তৈরি করতে হলে ব্যাংকারদের সহনশীলতা বাড়ানো এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তন দরকার। নারীরা ব্যবসা করতে পারবেন না—এমন ধারণা থেকে ব্যাংক কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসতে পারলে তবেই দেশের নারীরা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো দক্ষতা দেখাতে হবে। কেননা এটা মনে রাখতে হবে, নারী উদ্যোক্তাদের খেলাপি হওয়ার হার নেই বললেই চলে। করোনা মহামারীতে ব্যাংক অর্থায়ন না পেলে নারীদের সামনের দিনে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন হবে। এ পরিস্থিতিতে পারিবারিক অর্থায়নও বেশ ঝুঁকি তৈরি করবে। কেননা অর্থায়ন সংকটে পরিবারের অর্থ ফেরত চাইতে পারে। ফলে সেই অর্থ ফেরত দিতে হলে ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।