পূর্বের আলোচনায় আমরা ঋণের চারটি ভাগের কথা জানার চেষ্টা করেছিলাম। এবার আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। Loan Classification এর ক্ষেত্রে কয়েকটি সু-পরিচিত শব্দ আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যেমন SMA, Sub-Standard (SS), Doubtful (DF), Bad/Loss (BL) ইত্যাদি। লোনের সাথে জড়িত অনেকেই এই শব্দগুলোর অর্থ বুঝলেও অনেকেই হয়তো ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। আসুন একটু জেনে আসি এই টার্মগুলো সম্পর্কে।
ঋণ বিতরণের পরে ঋণের গতিধারা অনেক পরিবর্তন হয় আর এ পরিবর্তনটা হয় ঋণগ্রহীতার লেনদেনের উপর ভিত্তি করে। ঋণগ্রহীতা যদি নিয়মিতভাবে ঋণের কিস্তি কিংবা ঋণের জমা পরিশোধ করেন তো ঋণ হিসাবটি নিয়মিত ঋণ হিসেবেই গণ্য করা হবে। কিন্তু ঋণ গ্রহীতা যদি অনিয়মিতভাবে উঁনার ঋণ হিসাবে লেনদেন করেন তখন ঐ ঋণটি ঝুঁকির মধ্যে পড়েযায়। তখন ঐ ঋণের ঝুঁকির মাত্রাটি ঠিক কোন পর্যায়ে আছে তা যেন ঠিকমত নিরূপণ করা সম্ভব হয় তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে এই টার্মগুলা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আমাদের পূর্বের আলোচিত ৪ টি ভাগের ঋণগুলোর মধ্যে কোন প্রকারের ঋণগুলো কখন কোন ভাগে পড়ছে তা একটু জেনে নেয়া যাক। এখানে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখের ব্যাংকিং রেগুলেশন এন্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক জারিকৃত বিআরপিডি মাস্টার সার্কুলার নং ১৪ এবং ২১ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে জারিকৃত বিআরপিডি সার্কুলার নং ৩ কে যথাসম্ভব অনুসরণ করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। আর যেহেতু ঋণের এই টার্মগুলোর সাথে আমরা ইংরেজিতেই বেশি পরিচিত তাই আমি ইংরেজি টার্মগুলোই ব্যবহার করার চেষ্টা করছি।
অবজেক্টিভ বা উদ্দেশ্য ভিত্তিক বৈশিষ্ট্যঃ
SMA, Sub-Standard (SS), Doubtful (DF), Bad/Loss (BL) সম্পর্কে জানার পূর্বে আমাদেরকে Over Due সম্পর্কে আগে জানতে হবে। একটি ঋণ কখন Over Due হিসেবে গণ্য হবে? আসুন দেখে নেইঃ
১. Past Due/Over Due:
ক) যদি কোন Continuous Loan নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কিংবা ব্যাংক কর্তৃক দাবী করার পরও পরিশোধ বা নবায়ন না করা হয় তবে মেয়াদকালের পরবর্তী দিন থেকে তা Past Due/Over Due বলে বিবেচিত হবে।
খ) যদি কোন Demand Loan নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে কিংবা ব্যাংক কর্তৃক দাবী পরও পরিশোধ করা না হয় তবে মেয়াদকালের পরবর্তী দিন থেকে তা Past Due/Over Due বলে বিবেচিত হবে।
গ) Fixed Term Loan এর কোন কিস্তি বা কিস্তির অংশবিশেষ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে পরিশোধ করা না হয় তবে মেয়াদ পূর্তির তারিথের ৬(ছয়) মাস পর থেকে ঐ বকেয়া কিস্তিগুলোর পরিমাণকে Past Due/Over Due বলে বিবেচনা করা হবে।
ঘ) যদি কোন Short-Term Agricultural and Micro-Credit নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে পরিশোধ করা না হয় তবে মেয়াদপূর্তির ৬ মাস পর থেকে তাPast due/Overdue বলে বিবেচিত হবে।
Over Due ম্পর্কে জানলাম। এবার SMA সম্পর্কে একটু ছোট করে জেনে নেই চলুনঃ
২. Special Mention Account (SMA) হিসাব ছাড়া সকল Unclassified লোনগুলোকে Standard হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে কোন লোনগুলো SMA বলে বিবেচিত হবে? চলুন দেখা যাকঃ
৩. Continuous loan, Demand loan বা Term Loan যদি ২ মাস বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য অনাদায়ী কিংবা Overdue থাকে তবে সেগুলো Special Mention Account (SMA) এ স্থানান্তরিত হবে। লোনগুলোকে SMA হিসেবে চিহ্নিত করার মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যাংককে ঐ লোনগুলো সম্পর্কে আগাম একটা সতর্কবার্তা দেয়া। সতর্কবার্তা দেয়া এই জন্য যেন এইসকল লোনগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং ভবিষ্যতে যেন এই লোনগুলো ব্যাংকের দুঃশ্চিন্তার কারণ না হয় সে বিষয়ে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। Special Mention Account (SMA) গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরো, CIB কে অবহিত করতে হয়।
৪. ১৯৯১ সালের ব্যাংকিং কোম্পানি আইন এর ২৭(ক) (ক)(৩) এবং(৫)(গ)(গ) ধারা অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদী কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ ব্যতীত অন্যান্য ঋণের যেগুলো "Special Mention Account" এবং “Sub-Standard” এর আওতাধীন সেসব ঋণ খেলাপী ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২১ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখের ব্যাংকিং রেগুলেশন এন্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক জারিকৃত বিআরপিডি সার্কুলার নং ৩ মোতাবেক সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের একটা অংশ খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখাতে বলা হয়েছে।
Overdue এবং SMA সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল। এবার চলুন জেনে নেই কখন কোন ধরনের লোনগুলো Sub-Standard (SS), Doubtful (DF), Bad/Loss (BL) হচ্ছেঃ
৫. যেকোন Continuous Loan নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীকরণ করা হবে:
(ক) ‘Sub-Standard’ (নিম্নমান): যদি ঋণটি ৩ মাস বা ততোধিক কিন্তু ৯ মাসের কম সময় যাবত Past due/Overdue থাকে তবে তা ‘Sub-Standard’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
(খ) ‘Doubtful’ (সন্দেজনক): যদি ঋণটি ৯ মাস বা ততোধিক কিন্তু ১২ মাসের কম সময় যাবত Past due/Overdue থাকে তবে তা ‘Doubtful’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
(গ) ‘Bad/Loss’ (কু-ঋণ/মন্দ/ক্ষতি): যদি ঋণটি ১২ মাস বা ততোধিক সময়ের জন্য Past due/Overdue থাকে তবে তাকে ‘Bad/Loss’ বুঝাবে।
৬. যেকোন Demand Loan নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীকরণ করা হবে:
(ক) ‘Sub-Standard’ (নিম্নমান): মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ বা ব্যাংক কর্তৃক দাবি বা বাধ্যমূলক ঋণ সৃষ্টির সময় থেকে ৩ মাস বা ততোধিক কিন্তু ৯ মাসের বেশি নয় এমন সময়ের জন্য Past due/Overdue থাকা ঋণগুলোকে ‘Sub-Standard’ বোঝাবে।
(খ) ‘Doubtful’ (সন্দেজনক): Demand Loan এর ‘Doubtful’ লোন বলতে মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ বা ব্যাংক কর্তৃক দাবি বা বাধ্যমূলক ঋণ সৃষ্টির সময় থেকে ৯ মাস বা ততোধিক কিন্তু ১২ মাসের বেশি নয় এমন সময়ের জন্য Past due/Overdue থাকা লোনগুলোকে ‘Doubtful’ বোঝাবে।
(গ) ‘Bad/Loss’ (মন্দ/ক্ষতি): মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ বা ব্যাংক কর্তৃক দাবি বা বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টির সময় থেকে ১২ মাস বা ততোধিক সময়ের জন্য Past due/Overdue ডিমান্ড লোনগুলোকে ‘Bad/Loss’ বা কু-ঋণ/মন্দ/ক্ষতি ঋণ বোঝাবে।
৭. Fixed Term Loan এর যেকোন কিস্তি বা কিস্তির অংশবিশেষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধিত না হলে, মেয়াদ পূর্তির তারিথের ৬(ছয়) মাস পর থেকে অপরিশোধিত বা বকেয়া কিস্তিগুলো Past due/Overdue কিস্তি হিসেবে গণ্য করা হবে। যেকোন Fixed Term Loan নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীকরণ করা হবেঃ
(ক) ‘Sub-Standard’ (নিম্নমান): যদি ফিক্সড টার্ম লোন অথবা যে কোনও মেয়াদী ঋণের কিস্তি ৩ মাসের বেশি কিন্তু ৯ মাসের কম সময়ের জন্য Past due/Overdue থাকে তাহলে সম্পূর্ণ ঋণটিই ‘Sub-Standard’ হিসাবে শ্রেণীকরণ করা হবে।
(খ) ‘Doubtful’ (সন্দেজনক): যদি ফিক্সড টার্ম লোন অথবা যে কোনও মেয়াদী ঋণের কিস্তি ৯ মাসের বেশি কিন্তু ১২ মাসের কম সময়ের জন্য Past due/Overdue থাকে তাহলে সম্পূর্ণ ঋণটিই ‘Doubtful’ হিসাবে শ্রেণীকরণ করা হবে।
(গ) ‘Bad/Loss’ (মন্দ/ক্ষতি):যদি ফিক্সড টার্ম লোন অথবা যে কোনও মেয়াদী ঋণের কিস্তি ১২ মাস বা ততোধিক সময়ের জন্য Past due/Overdue থাকে তাহলে সম্পূর্ণ ঋণটিই ‘Bad/Loss’ হিসাবে শ্রেণীকরণ করা হবে।
৮. যদি ঋণ চুক্তিতে উল্লেখিত নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে পাওনা পরিশোধে ঋণগ্রহীতা ব্যর্থ হয় তবে Short-Term Agricultural and Micro-Credit ঋণগুলো অনিয়মিত ঋণ বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে বর্ণিত ঋণের অনিয়মিত অবস্থা যদি এভাবে চলতেই থাকে তবে ঋণ চূক্তি অনুযায়ী ১২ মাস পরে এ ঋণ 'Sub-Standard' হিসেবে, ৩৬ মাস পর 'Doubtful' হিসাবে এবং ৬০ মাস পর 'Bad/Loss' হিসাবে গণ্য হবে।
ঋণের শ্রেণীকরণ বিষয়ক আলোচনার এখানেই তাহলে ইতি টানছি আজ। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে কোন যায়গায় ভুল-ভ্রান্তি থাকতেই পারে, তেমনটা চোখে পড়লে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন প্লিজ। ভবিষ্যতে ঋণের নতুন কোন বিষয়ে আলোচনা হবে আশা করছি। তবে তার আগে আমি নিজেই তো আগে জানতে হবে, তাই না? তবে কেউ যদি আমাকে কিছু জানাতে চান সেটা আমি সাদরে গ্রহণ করব। কারণ আলোচনা কিংবা শেয়ারিং এর মাধ্যমেই খুলে যায় অনেক জট, বেড়ে যায় জানার পরিধিও, তাইনা?
লেখকঃ প্রণব চৌধুরী, ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, গোলাপগঞ্জ শাখা, সিলেট।