ঋণ ও অগ্রিম, ইংরেজিতে বললে লোন এন্ড এডভান্স ব্যাংকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্ষেত্র। মূলত ব্যাংকের আয়ের মূল উৎস হিসেবে এই জায়গাটাকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে ঋণ বিতরণ করে ফেললেই যে তা ব্যাংককে আয় এনে দিবে তা কিন্তু নয়। এইজন্যই আমাদেরকে গুণগত ঋণ বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আমরা যে ঋণ বিতরণ করব তার যেন গুণগত মান ঠিক থাকে। কারণ মানহীন ঋণ ব্যাংকের শুধু যে ক্ষতির কারণ হয় তা কিন্তু নয় ব্যাংকের জন্য তা হয়ে যায় বোঝা স্বরূপ। তাই ঋণ বাছাই ও প্রদান এবং ঋণ বিতরণ পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায় আমরা যে ঋণগ্রহিতাকে বাছাই করেছি তিনি কিংবা তাকে প্রদানকৃত ঋণটি ঠিকই গুণগত মান সম্পন্ন কিন্তু সঠিকভাবে পরিচর্যার অভাবে সেটি Bad Loan হয়ে যাচ্ছে। তা লোনগুলো কখন Bad Loan হয়ে যায়? কত প্রকারের লোনই বা আছে চলুন সেগুলো ধাপে ধাপে জেনে নেয়া যাক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখের ব্যাংকিং রেগুলেশন এন্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক জারিকৃত বিআরপিডি মাস্টার সার্কুলার নং ১৪ অনুযায়ী ঋণ ও অগ্রিম(লোন এন্ড এডভান্স) গুলোকে আমরা চারটি গ্রুপে ভাগ করতে পারিঃ
১. ধারাবাহিক ঋণ বা কন্টিনিউয়াস লোন(Continuous Loan)
২. চাহিদা ঋণ বা ডিমান্ড লোন(Demand Loan)
৩. স্থায়ী মেয়াদী ঋণ বা ফিক্সড টার্ম লোন(Fixed Term Loan) এবং
৪. স্বল্প মেয়াদী কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ বা শর্ট টার্ম এগ্রিকালচার ও মাইক্রো-ক্রেডিট (Short-term Agricultural & Micro- Credit)
১. ধারাবাহিক ঋণ বা কন্টিনিউয়াস লোন(Continuous Loan):
আমাদের কাছে পরিচিত ক্যাশ ক্রেডিট বা ওভারড্রাফট ঋণ গুলো এই প্রকৃতির ঋণ। এইসকল ঋণ হিসাবে একটি নির্দিষ্ট সীমা বা লিমিটের মধ্যেই লেনদেন সীমাবদ্ধ থাকে এবং ঋণের পূর্ণ পরিসমাপ্তির জন্য একটি নির্দিষ্ট Expiry Date থাকে যার মধ্যে ঋণটি বন্ধ (Close) বা নবায়ন (Renew) করতে হয়। অর্থাৎ এসব ঋনের ক্ষেত্রে আমরা গ্রাহককে একটি ঋণ হিসাব খুলে দিয়ে সে হিসাবের জন্য মঞ্জুরীকৃত একটি লিমিট নির্দিষ্ট করে দেই। গ্রাহক তার সুবিধামত ঐ লিমিটের মাঝে যতবার খুশি টাকার উত্তোলন ও জমা করতে পারে। তবে ঋণগ্রহিতাকে অবশ্যই সেই ঋণ হিসাবের নির্দিষ্ট Expiry Date এর মধ্যে সুদসহ ঋণের সমুদয় টাকা পরিশোধ করে ঋণ হিসাবটি বন্ধ করে দিতে হয় অথবা নবায়ন এর জন্য আবেদন করতে হয়।
২. চাহিদা ঋণ বা ডিমান্ড লোন(Demand Loan):
এসকল ঋণগুলো ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী অন ডিমান্ড পরিশোধযোগ্য বলে বিবেচিত। যদি কোন কনটিন্টজেন্ট বা সম্ভাব্য অথবা অন্য যেকোন দায়কে ফোর্সলি ফেরত দিতে বলা হয়ে থাকে তবে তাকেও ডিমান্ড লোন হিসেবে গণ্য করা হবে। ডিমান্ড লোনের উদাহরণ হিসেবে আমরা ফোর্সড লোন এগেইনস্ট ইম্পোর্টেড মার্চেন্ডাইজ, পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট, ফরেন বিল পার্সেজ, ইনল্যান্ড বিল পার্সেজড ইত্যাদি লোনগুলোকে বিবেচনা করতে পারি।
৩. স্থায়ী মেয়াদী ঋণ বা ফিক্সড টার্ম লোন(Fixed Term Loan):
ফিক্সড টার্ম লোনগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে এবং ঐ সময়সীমার মাঝে ঋণটি পরিশোধ করার জন্যে একটি নির্দিষ্ট শিডিউল ঠিক করে দেয়া থাকে। যেমন আমরা যে পার্সোনাল ঋণগুলো বিতরণ করে থাকি সেগুলোর কিন্তু নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে যেমন চার/পাঁচ বছর এবং ঐ চার/ পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে ৪৮/৬০ টি সমান কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া থাকে।
৪. স্বল্প মেয়াদী কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ বা শর্ট টার্ম এগ্রিকালচার ও মাইক্রো-ক্রেডিট (Short-term Agricultural & Micro- Credit):
বাংলাদেশ ব্যাংকের Agricultural Credit and Financial Inclusion Department (ACFID) নামে একটি ডিপার্টমেন্ট আছে যারা প্রতি বছর একটি বার্ষিক ঋণ প্রকল্প বা কর্মসূচী (Annual Credit Programme) ইস্যু করে থাকে। সেই প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত স্বল্পমেয়াদী ঋণগুলোই হলো স্বল্প মেয়াদী কৃষি ঋণ। কৃষি সেক্টরের যেসকল ঋণ ১২ মাসের মধ্যে পরিশোধযোগ্য সেসব ঋণও এর আওতাধীন। স্বল্প মেয়াদের ক্ষুদ্র ঋণ বলতে সময় সময় ACFID কর্তৃক নির্ধারিত অংকের অনধিক পরিমাণ অর্থ যা ১২ মাসের মধ্যে পরিশোধযোগ্য তা যেনামেই ডাকা হোক না কেন সেগুলো এ ধরণের ঋণের পর্যায়ভুক্ত বলে বিবেচিনা করা হয়। অ-কৃষিযোগ্য ঋণ, আত্ম নির্ভরশীল ঋণ, ব্যাংকের একক প্রকল্প ঋণ এই শ্রেণীভুক্ত।
আজ তাহলে এই পর্যন্তই থাক। পরবর্তী আলোচনায় আমরা ঋণ শ্রেণীকরণের ভিত্তি এবং ঋণের অবজেক্টিভ বা উদ্দেশ্য ভিত্তিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। অর্থাৎ আলোচ্য ৪ শ্রেণীর ঋণগুলোর মধ্যে কোনগুলো কখন কিভাবে Overdue হচ্ছে এবং এই Overdue লোনগুলো কখন কোন পর্যায়ে গিয়ে SMA, Sub-standard (SS), Doubtful (DF), Bad/Loss (BL) হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে জানব।
গুণগত ঋণ বৃদ্ধি করে এবং শ্রেণীকৃত ঋণ আদায় করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের ব্যাংকিং তথা আর্থিক সেক্টর ২০২১ সালেও এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিতে।
লিখেছেনঃ প্রণব চৌধুরী, ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, গোলাপগঞ্জ শাখা, সিলেট।