ঢাকা শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
করোনায় বহুমুখী চ্যালেঞ্জে ব্যাংক খাত
  • এম. এ. মাসুম
  • ২০২০-১২-২৪ ১১:১৬:০১

বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণে টালমাটাল পুরো বিশ্ব ব্যবস্থা। হুড়মুড় করে যেন ভেঙে পড়ছে বিশ্বের তাবৎ বড় বড় অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়াসহ এমন কোনো অঞ্চল বা দেশ নেই যেখানে করোনার থাবা পড়েনি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির রথী-মহারথী সব দেশেরই উৎপাদন খাত এখন পুরোপুরি ধরাশায়ী। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে পুঁজি, মুদ্রা ও পণ্যবাজার। এ অবস্থায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আশঙ্কা করছে, প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে ৪ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ দেশই অর্থনীতি চলমান রাখতে ব্যালআউট প্যাকেজ ঘোষণা করছে।

করোনা ভাইরাসের মহামারি নিয়ে সংকট কাটাতে প্রতিদিনই নানা উদ্যোগ ঘোষণা দিচ্ছে বিশ্বের দেশের ব্যাংক ও সংস্থা। সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে এনেছে ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড)। অন্যদিকে ৮২০ বিলিয়ন ডলার জরুরি তহবিলের ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় কেন্দ্রী ব্যাংক। যুক্তরাজ্য তাদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে (শূন্য দশমিক ১ শতাংশ) নামিয়ে এনেছে সুদের হার। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আংশিক জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। ৮২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে কানাডা। শুধু দেশগুলোই নয়, জরুরি তহবিল করেছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রাতহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক বাণিজ্য, স্বাস্থ্য খাত, সরকারি অর্থায়ন ও মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি হয়েছে একরকম বিশৃঙ্খলা।

সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।

দেশের আমদানি-রপ্তানি দূরের কথা, অধিকাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে নেতিবাচক অবস্থায় দেশের অর্থনীতি। তাই চলতি বছর দেশের ব্যাংক খাতের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদগণ।

করোনা ঠেকাতে বর্তমানে পুরো দেশে চলছে অঘোষিত ‘লকডাউন’। সীমিত আকারে ব্যাংকের কার্যক্রম চালু থাকলেও অন্য সব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ। দেশের অন্যতম রপ্তানি আয়ের খাত পোশাক কারখানাও বন্ধ। তাদের রপ্তানি আদেশ বাতিল হচ্ছে একের পর এক। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে গত কয়েকমাসে এখন পর্যন্ত ২৯১ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বা ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন ক্রেতারা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা ইউরোপ ও আমেরিকার দেশ। বর্তমান সময়ে করোনায় ভয়াবহ বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের দেশগুলো। এসব দেশ ও অঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে নতুন করে ক্রয়াদেশ পাওয়ার সম্ভাবনাও নাই।

দেশের আরেকটি বড় আয়ের খাত প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) ধস শুরু হয়েছে। করোনা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই আশংকা করা হচ্ছিল প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে আশংকাই বাস্তব হতে চলেছে। অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো সূচকটির খারাপ খবর এল। কমে গেছে প্রবাসী আয়। গত মার্চ মাসে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ১৬ কোটি ৬২ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৪২৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট্রদের ধারণা, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে প্রবাসী আয় কমে এসেছে এবং আগামীতে আরও কমতে পারে।

ব্যাংক খাতের সিংহভাগ আয় হয় পোশাক, লেদার, সিরামিক ও ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। এ ছাড়া আসে রেমিট্যান্স থেকে। সেগুলো এখন থমকে গেছে। কত দিন এ অবস্থা চলবে সেটা বলা যাচ্ছে না। কত দিন পর স্বাভাবিক রেমিট্যান্স আসা শুরু হবে তা বলা মুশকিল। এক অনির্দিষ্ট সংকট বেড়ে যাচ্ছে।

এমনিতেই খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যাংক খাত। করোনার প্রভাবে দেশের সকল ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ আছে। আবার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকারদের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে ঋণের টাকা আদায় করা কঠিন হবে। ফলে আগামীতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিশাল আকারে বেড়ে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে।

চীন ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। সেখান থেকে কাঁচামাল আমদানি শুরু হয়েছে। তবে আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা বা কর্মরত শ্রমিকরা তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। এমনকি যে দেশে রপ্তানি করা হয় সে দেশের অবস্থাও করোনায় বিপর্যস্ত। এ সংকটকালে উদ্যোক্তাদের জন্য নানা ছাড় দিচ্ছে ব্যাংক।

সরকার দেশের শ্রমিকদের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে পাঁচ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেছে, এটি দিয়ে পোশাক খাতের কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন দেয়া যাবে। সমস্যা হচ্ছে চলমান অবস্থা কত মাস চলবে বলা যাচ্ছে না। দেশে সব খাতে প্রায় ৬ কোটি মানুষ কর্মরত। তাদের সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কত দিন ভর্তুকি দিয়ে বেতন দেবে। আয় না বাড়লে প্রতিষ্ঠানগুলো চলা সম্ভব হবে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন,সবচেয়ে সংকটে পড়বে আমাদের দেশের ব্যাংক খাত। কারণ ব্যাংকের যে টাকা আছে, সেটি গ্রাহকের আমানত। উদ্যোক্তাদের কত মাসই-বা ছাড় দেয়া সম্ভব হবে। ব্যবসায়ীরা যদি ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না পারে তবে ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়বে। গ্রাহক তার গচ্ছিত টাকা ফেরত চাইলে ব্যাংক দিতে পারবে না। ব্যাংকের মূলধন যদি ব্যাংক ভেঙে কর্মকর্তাদের বেতন ও আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করে, তাহলে ব্যাংক খাতে যে নগদ অর্থ সংকটে পড়বে তার প্রভাব দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে পড়বে। অনেক আমানতকারী আছেন যারা ব্যাংকে রাখা আমানতের বিপরীতে পাওয়া সুদ থেকে সংসার চালায়। সেটা বাধাগ্রস্ত হবে।

এই ক্রান্তিকালে ব্যাংক সীমিত আকারে চালু আছে। ব্যাংকাররা অফিস করছেন অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই। তবে অনেক ব্যাংক জীবাণু প্রতিরোধমূলক পোশাকের ব্যবস্থা করেছে এবং নানাভাবে কর্মীদেরকে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করছে।

ব্যাংক বন্ধ থাকলে গ্রাহক তার গচ্ছিত টাকা এই আপৎকালে তুলতে পারবে না। এ জন্য ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে রোটেশন ভিত্তিতে। একটি শাখায় যদি ৪০ জন কর্মকর্তা থাকেন, তবে এক দিনে ১০ জন কাজ করছে। অর্থাৎ একজন কর্মকর্তা চার দিন পরপর অফিস করছেন। তার পরও ঝুঁকি রয়েছে।

সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত এ বছর সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্যাংকাররা আশংকা করছেন চতুর্মুখী সংকটে পড়বে ব্যাংক। ব্যাংক খাতের এ সংকট কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে নীতিনির্ধারকদেরকে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামের শেষে ‘পিএলসি’, সুবিধা-অসুবিধা
পদোন্নতি হলোনা, কি করবেন
রাশিয়ার উপর নিষেধজ্ঞায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে প্রভাব