পদোন্নতি বা পদোন্নয়ন বলতে কোনো কর্মীকে তার বর্তমানে আসীন পদ হতে উচ্চতর দায়িত্ব ও পদমর্যাদা সম্পন্ন পদে উন্নীত করাকে বুঝায়। যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই পদোন্নয়ন কর্মীদের উত্তম কাজ হিসেবে গন্য করা হয়ে থাকে। এতে কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীদের প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা সম্ভব হয়।
চাকরিতে পদোন্নতি পেতে কে না চায়? কিন্তু বেশিরভাগ কর্মী পদোন্নতি পাওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য হিসাবে উপস্থাপন করতে হিমশিম খান।এ ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী কর্মপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে পদোন্নতিকে আলিঙ্গন করা সম্ভব।
পেশাজীবনে আমরা যতই এগিয়ে যাই, ততই পদোন্নতির সুযোগ ও প্রত্যাশার বিকাশ ঘটে। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর মে-২০১৬ সংখ্যার এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, মধ্যবয়সের পেশাজীবন যাঁদের, তাঁদের ৪১ শতাংশ পদোন্নতি না হওয়ার কারণে কর্মস্থল পরিবর্তন করেন। পদোন্নতি না হওয়ার কারণে ৭৩ ভাগ কর্মীর মধ্যে হতাশা ভর করে। যে হতাশার বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও কাজের মান ও গতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পদোন্নতির সঙ্গে দক্ষতার বিষয়টি জড়িত, যা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাজের মান ও গতির ওপর প্রভাব ফেলে। বিষয়টি শুধু বেতন বা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, কর্মীদের অনুপ্রেরণা ও কাজে আগ্রহী করে তোলার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহকারী অধ্যাপক সাইফ নোমান খান বলেন, ‘কর্মস্থলে গতিশীলতা আনতে পদোন্নতি বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি বিষয়টিকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয় না। পদোন্নতি না হলে কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা যায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সামগ্রিক কাজের ওপর। আবার হুটহাট ‘গণ পদোন্নতি’ কাজের মান কমিয়ে দেয়। কর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক রেষারেষি তৈরি করে। কখনো কখনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনিয়মিত পদোন্নতি তরুণ মেধাবী নতুন কর্মীদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে নিরুৎসাহিত করে। বিজনেস স্ট্র্যাটেজি স্পেশালিস্ট শিক্ষক সাইফ নোমান খান পদোন্নতিকে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের স্বার্থেই ইতিবাচকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা উচিত বলে মনে করেন। পেশাজীবনে পদোন্নতি নিয়ে সাইফ নোমান খান প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের বেশ কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন।
পেশাজীবনে পদোন্নতির প্রত্যাশা সবারই থাকে। কিন্তু সব সময় সবার কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি না-ও হতে পারে। প্রতিষ্ঠান নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী উপযুক্ততা বিবেচনা করে কাউকে কাউকে পদোন্নতি দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কর্মীর কর্মদক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা এবং প্রয়োজনটাও বিবেচ্য।
সমস্যা হচ্ছে আজকাল আমাদের দেশে অনেক সময় যোগ্য ব্যক্তিকে পদোন্নতি দেয়া হয়না। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি,আঞ্চলিকতা,বসের দূরদর্শিতার অভাব,সেকেলে পদোন্নতি পদ্ধতি,ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বহু অযোগ্যদেরকে পদোন্নতি দেয়া হয়, আবার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে যোগ্যদের কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি।
পদোন্নতিবঞ্চিত ব্যক্তি যদি হতাশ হয়ে পড়েন, তাহলে মুশকিল। এ সময় নিজেকে সামলে নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে পারাটাই পেশাদারির পরিচয়। তা না করতে পারলে পেশাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ব্যক্তিজীবনেও হতাশা, উদ্বেগ ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা জরুরি।
কাঙ্খিত পদোন্নতি না পেলে কি করবেন, এর উত্তর দেয়া সত্যিই কঠিন। তবে আত্নবিশ্বাসী করে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তি ও চিন্তাবিদরাও এ বিষয়ে নানা উপদেশ দিয়েছেন। বিশ্বখ্যাত লেখক ও মোটিভেটর ডেল কার্নেগী বলেন, “ব্যর্থতার ছাই থেকে সাফল্যের প্রাসাদ গড়ো। হতাশা আর ব্যর্থতা হলো সাফল্যের প্রাসাদের দুই মূল ভিত্তি”। ভারতের বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী ,ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আব্দুল কালাম এর মতে,“মানুষের জীবনে কঠিন সময় আসাটা খুব দরকার। কঠিন সময়ের কারণেই মানুষ সাফল্য উপভোগ করতে পারে”। আবার বন জোভি বলেছেন, “সাফল্য মানে ৯ বার পড়ে গিয়ে ১০ম বার উঠে দাঁড়ানো”। তার মানে দাঁড়াচ্ছে সফলতা না আসা মানেই নিজেকে ব্যর্থ মনে না করা। কারণ সফলতা যে কোন সময় ধরা দিতেও পারে।
পদন্নোতি না পেলে আপনি যেসব বিষয়গুলো মেনে চলতে পারেনঃ
তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
পদোন্নতির বিষয়ে ‘না-সূচক’ খবর শুনে অপ্রস্তুত হয়ে যান অনেকেই। ক্ষোভে ফেটে পড়েন, হতাশায় মুষড়ে পড়েন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সবাই আপনাকে লক্ষ করছে। আপনি যে পদোন্নতি-প্রত্যাশী সে বিষয়টি সহকর্মীরা কম-বেশি সবাই জানেন। মুহূর্তের অপেশাদার মনোভাব, বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ আপনার সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। আপনার দীর্ঘদিনের সুনাম নষ্ট করতে পারে। তাই তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ বজায় রাখুন। ব্যক্তিত্ব অক্ষত রেখে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। প্রয়োজনে একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী সহকর্মীর সঙ্গে কিছু সময় কথা বলে বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টা করুন।
অন্যদের অভিনন্দন জানান
নিঃসংকোচে অন্যদের অভিনন্দন জানান। আপনার চেয়ে উঁচু পদের হোক বা নিচু পদের, যাঁরাই পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানান। নিজ বিভাগের বাইরে অন্যদেরও খোঁজ নিন, শুভেচ্ছা জানান। অফিসের পরিচিত অনেকেই নিজে থেকে আপনার কাছে তাঁদের খবর নিয়ে আসতে পারেন। সবাইকে হাসিমুখে অভিনন্দিত করুন। নিজের বিষয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কিছু নেই। কারণ, পদোন্নতি না পাওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনার দীর্ঘদিনের অর্জন বৃথা হয়ে গেছে। তাই কর্মস্থলের অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তায় যেন আপনার ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ না থাকে।
ভারসাম্য বজায় থাক
ব্যক্তিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ পেশাজীবন। আমাদের সারা দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাটে কর্মক্ষেত্রে, পেশাগত ব্যস্ততায়। তাই দিন শেষে আপনার হাসিমুখ দেখা থেকে পরিবারের অন্যরা যাতে বঞ্চিত না হন, সেদিকে খেয়াল রাখুন। কর্মক্ষেত্রের নেতিবাচক কোনো বিষয় যেন পরিবারের অন্যদের প্রভাবিত না করে। স্বাভাবিক সম্পর্ক বা যোগাযোগে যেন ভাটা না পড়ে। প্রয়োজনে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনকে নিজে থেকেই বিষয়টি জানিয়ে দিতে পারেন। এতে আপনি চাপমুক্ত হবেন, স্বাভাবিক থাকবেন। দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারবেন সহজে।
বসের সঙ্গে বোঝাপড়া
বসের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিন। বিনয়ের সঙ্গে আপনার প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির বিষয়টি অবহিত করুন। নম্রভাবে প্রকৃত কারণটি জানতে চান। পুনর্বিবেচনার সুযোগ না থাকলে নিজের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার ফিরিস্তি না দিয়ে প্রতিষ্ঠানের অবস্থা, পরিকল্পনা এবং নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করুন। প্রশ্নের উত্তরেই আপনার প্রতি বসের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হবে। পেশাজীবনে উন্নয়নের জন্য কোন কোন বিষয়ের প্রতি সজাগ থাকা দরকার, এসব বিষয় তিনি বলতে চাইলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। প্রতিষ্ঠানের পরবর্তী পরিকল্পনার বিষয়টিও নিয়ে আসুন বসের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে। এতে আপনার আগ্রহ প্রকাশ পাবে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তিনি আপনাকে কীভাবে রাখতে চান সেটাও জেনে নিতে চেষ্টা করুন। তাহলে আপনার জন্য নিজের বিষয়ে পরিকল্পনা করাটাও সহজ হবে।
নিজে বুঝুন, নিজেকে বোঝান
ঠান্ডা মাথায় আত্ম-মূল্যায়নে মনোনিবেশ করুন। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলুন। প্রয়োজনে কাগজে লিখে ফেলুন। বিগত ছয় মাস থেকে এক বছরে প্রতিষ্ঠানের কী কী কাজ সফলভাবে করেছেন, তার একটা তালিকা তৈরি করুন। পাশাপাশি যা করতে পারেননি, তা-ও লিখে ফেলুন। এ কাজগুলো করতে পারা না-পারার মাঝে নিজের ভুলগুলো উঠে আসবে। এর পাশাপাশি নিজের শক্তিগুলোও আরেকবার অনুধাবন করার চেষ্টা করুন। কারণ, আপনিই সবচেয়ে ভালো জানেন—আপনি কী পারেন, কী করেছেন আর কী করতে পারেননি। মিলিয়ে দেখুন আরও কী কী করা দরকার ছিল। এবার নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখুন—আপনার কতটুকু প্রাপ্য ছিল, আর কতটুকু বঞ্চিত হয়েছেন।
পরিকল্পনা থেকে প্রস্তুতি
আত্মমূল্যায়ন শেষে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাবই আপনাকে তাগিদ দেবে নতুন করে শুরু করার। হতে পারে সেটা আগের প্রতিষ্ঠানেই কিংবা অন্যত্র। প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও কর্তৃপক্ষের মনোভাবেই বোঝা যাবে—এ বছরটি আপনার জন্য কতটুকু সুগম। ভুলগুলো শুধরে এখানে কাজ করলে কত দূর যাওয়া সম্ভব, তা-ও ভেবে দেখুন। ইতিবাচক সম্ভাবনা থাকলে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। তা না হলে কর্ম-পরিবেশ ও পেশার পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনায় আনুন। উন্নতির অন্তরায় যদি আপনি নিজে না হয়ে এসব পারিপার্শ্বিক অবস্থা হয়, তাহলে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে বসুন, নতুন চাকরির সন্ধান শুরু করুন এখনই।
সুসম্পর্ক
সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচটি পদোন্নতির মধ্যে চারটি পদোন্নতি হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে। এ সুসম্পর্ক হতে পারে বিভিন্ন উপায়। যেমন ঠিকঠাক কাজ করা, অফিসের চাহিদা মতো ইনপুট আউটপুট প্রদান করা ও নিত্য নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা রাখা। একইভাবে অন্য সহকর্মীদের জন্যও সাহায্যের মানসিকতা রাখা চাকরিতে সফলতা লাভে সহায়ক হিসাবে কাজ করে।
লেখকঃ ব্যাংক কর্মকর্তা ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইলঃ ma_masum@yahoo.com