করোনাকালীন সময়ে বেসরকারী ব্যাংক কর্মীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি নির্দেশনা জারী করে যা ব্যাংক খাতের সর্ব মহলে প্রশংসীত হয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারী ব্যাংকের কর্মীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ফজলে কবীরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা নির্ধারণ
ব্যাংক খাতে মেধাবীদের আকর্ষণ করতে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দিয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকের নিচের পদগুলোতে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তাদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা হবে ২৮ হাজার টাকা। শিক্ষানবিশকাল শেষ হলে প্রারম্ভিক মূল বেতনসহ ন্যূনতম মোট বেতন-ভাতা হবে ৩৯ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই সার্কুলারটি আগামী মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোকে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতিমালা পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোতে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে একেবারে কম বেতন নির্ধারণ করা হতো। এছাড়া একই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেতনের হেরফের হতো। এতে স্বজনপ্রীতি হতো। এতে ব্যাংকের নতুন কর্মীদের মনোবল নষ্ট হতো। যা ব্যাংকিং খাত বিকাশের অন্তরায় ছিল। এসব সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকের নিচের স্তরে কর্মকর্তা ও অন্যান্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দিল। কোনো ব্যাংক এর কম দিতে পারবে না। তবে বেশি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।
সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংকের এন্ট্রি পর্যায়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার, ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার, ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশ অফিসার অথবা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, শুরুতে এসব কর্মকর্তার শিক্ষানবিশকালে ন্যূনতম বেতন-ভাতাদি হবে ২৮ হাজার টাকা। শিক্ষানবিশকাল শেষে কর্মকর্তাদের প্রারম্ভিক মূল বেতনসহ ন্যূনতম সর্বমোট বেতন-ভাতাদি হবে ৩৯ হাজার টাকা।
নতুন নির্ধারিত বেতন-ভাতাদি কার্যকর করার পর একই পদে আগে থেকে কর্মরত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাদি আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের বেতন ভাতাদি কম হবে না। প্র্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্ন পদে কর্মরত কর্মকর্তার বেতন-ভাতাদির সঙ্গে ব্যাংকে সর্বনিম্ন পদে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদির পার্থক্য যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে।
অনুরূপভাবে অন্য সব স্তরের কর্মকর্তাদের জন্যও আনুপাতিক হারে বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ করতে হবে। কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন-ভাতাদি কোনো অবস্থাতেই বর্তমান বেতন-ভাতাদির চেয়ে কম হবে না। তবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইনক্রিমেন্ট দিয়ে বেতন-ভাতাদি সমন্বয় করতে হবে।
টার্গেট পূরণে বাধ্য করা যাবেনা
এতে আরও বলা হয়, কর্মকর্তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ বা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জনের শর্ত আরোপ করা যাবে না। শুধু নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারা বা অদক্ষতার অজুহাতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না।
একই সঙ্গে এই ধরনের অজুহাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা বা পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।
কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কর্মচারীদের সর্বনিম্ন বেতনও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে আলোচ্য সার্কুলারে। এতে বলা হয়, ব্যাংকের মেসেঞ্জার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, অফিস সহায়ক অথবা সমজাতীয় পদ বা সর্বনিম্ন যে কোনো পদের কর্মচারীদের ন্যূনতম প্রারম্ভিক বেতন-ভাতাদি হবে ২৪ হাজার টাকা।
চুক্তিভিত্তিক বা দৈনিক ভিত্তিতে বা আউটসোর্সিং বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি কর্মচারীদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়, সেক্ষেত্রে স্থায়ীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ করতে হবে। এখানেও ইচ্ছামাফিক বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা যাবে না।
ব্যাংক কর্মীদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবেনা
গত ২০২০ সন থেকে করোনাকালীন সময়ে প্রায় চার হাজার ব্যাংক কর্মীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এর ফলে বেসরকারী ব্যাংক খাতে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ফলে গত বেছরের সেপ্টম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারী করে।সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ব্যতীত ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাঁদের বিধিমোতাবেক চাকরিতে বহালের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি করোনাকালীন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা বা অদক্ষতার কারণে চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলেছে, সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।
এমন পরিস্থিতিতে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনায় এবং এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা অটুট রাখার স্বার্থে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
১. সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত না করা।
২. করোনাকালীন শুধু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা বা অদক্ষতার কারণ প্রদর্শন করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত অথবা পদত্যাগ করতে বাধ্য না করা।
চাকুরিচ্যুতদের পূণর্বহালের নির্দেশ
৩. পয়লা এপ্রিল ২০২০ তারিখ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের (আবেদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধিমোতাবেক চাকরিতে বহাল করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি ২০১৭ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম, পদবি, পদত্যাগের কারণ, ওই কর্মকর্তার বর্তমান অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এর মাধ্যমে পরিষ্কার হবে, ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হওয়া কী পরিমাণ কর্মকর্তা বেকার হয়ে পড়েছেন।
স্থায়ী সাব-স্টাফদের চুক্তিভিত্তিক কর্মীতে রূপান্তর করা যাবে না
নিম্নপদের কর্মীদের সঙ্গে অবিচার করার ঘটনা ঘটেছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে (এসআইবিএল)। নিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন করে ব্যাংকটির নিয়মিত সাব-স্টাফদের ১ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক কর্মীতে রূপান্তর করার অভিযোগ উঠে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ব্যাংকটির এ অনৈতিক সিদ্ধান্ত বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, সাব-স্টাফরা হলেন ব্যাংকের নিম্নপদের কর্মী। যারা পিয়ন, গার্ড, ড্রাইভার ও ম্যাসেঞ্জার হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে সারাদেশে এসআইবিলের স্থায়ী সাব-স্টাফ রয়েছেন ২ শতাধিক।
গতকাল ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এ পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত স্থায়ী সাব-স্টাফদের চুক্তিভিত্তিক কর্মীতে রূপান্তর করা যাবে না। তবে ভবিষ্যতে চুক্তিভিত্তিক সাব স্টাফ নিয়োগে কোনো বাধা নেই। মূলত এ ধরনের সিদ্ধান্ত সার্বিক ব্যাংক খাতে কর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।