জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা 'ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্স' বিশ্ব ব্যাপী আর্থিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে এসএমই খাতের উন্নয়ন হচ্ছে। ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্সের ফলে আরও অধিক ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
কোন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তার বকেয়া বিল কমিশনে দেনাদার ব্যতীত তৃতীয় কোন পক্ষের নিকট বিক্রি করাকে ফ্যাক্টরিং বলে। ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্স হচ্ছে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিল বা ইনভয়েসের বিপরীতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্রিম ঋণ সুবিধা। অর্থাৎ যে কোনো দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রমের লেনদেনের বিল বা ইনভয়েসের বিপরীতে টাকা পেতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সেই বিল বা ইনভয়েসের বিপরীতে প্রাপক প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে থাকে, যাতে সে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের টাকা দিয়ে একই সময়ের মধ্যে কয়েক গুণ ব্যবসা করতে পারে।
পণ্য বা সেবা সরবরাহকারী বিভিন্ন উৎপাদনকারী বা সেবা প্রতিষ্ঠানকে তাদের পণ্য বা সেবা একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য বাকিতে সরবরাহ করতে হয়। এই সময় তাদের চলমান মূলধন সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। সেদিক বিবেচনা করেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো 'ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্স' সেবা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্সের ধারণা অনেক পুরনো হলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এর কার্যক্রম সেভাবে শুরু করতে পারেনি। গত ২৫ জুন, ২০২০ বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টরিংয়ের উপর একটি গাইড লাইন প্রণয়ন করে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফ্যাক্টরিং (আমদানিকারক, রফতানিকারক ও দুই দেশের দুই এজেন্টের গ্যারান্টিতে রফতানি বিল বন্ধক রেখে নেয়া ঋণ) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ঋণ নেয়া যাবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুদের হার কম থাকায় এই ঋণের সুদের হারও কম হবে। আন্তর্জাতিকভাবে ফ্যাক্টরিং পরিচালনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফ্যাক্টরিং চেইন ইন্টারন্যাশনাল (এফসিআই) নামে একটি সংগঠন রয়েছে। এর সদস্য হয়ে এই প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হয়। এর আওতায় বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলার লেনদেন হয়। এতে রফতানিকারক, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট দুই দেশের একজন করে চার প্রতিনিধি যুক্ত থাকেন। এদের এফসিআইয়ের সদস্য হতে হয়। তাহলেই রফতানিকারকের রফতানি বিল বন্ধক রেখে বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিতে পারবে। বর্তমানে সেটা নেই। শুধু রফতানি বিল বন্ধক রেখে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাণিজ্য প্রসার ও আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে অর্থায়নের বিকল্প মাধ্যম হতে পারে ফ্যাক্টরিং। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ফ্যাক্টরিং এর বিশাল টার্নওভার রয়েছে। এটি বিশেষ করে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি আকারের ব্যবসার আর্থিক চাহিদার জন্য সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য।ফ্যাক্টরিং উন্নয়নশীল ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে।আমেরিকা এবং ইউরোপের আন্তঃ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ফ্যাক্টরিক পুরোপুরিভাবে পরিচালিত হচ্ছে।এশীয় অঞ্চলেও এখন ফ্যাক্টরিং বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফ্যাক্টরিং, একটি দেশের বাণিজ্যি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে এটির পরিধি তাত্পর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে বৈশ্বিক ফ্যাক্টরিং সেবার বাজার মূল্য ছিল ৩,২৩৫.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২১ সাল থেকে ২০২৮ পর্যন্ত ৮.৪% হারে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ওপেন অ্যাকাউন্ট লেনদেন বৃদ্ধি, এশিয়ার ব্যবসার দ্রুত সম্প্রসারণ, বৈশ্বিক ব্যবসা বাণিজ্য চীন নেতৃত্ব বৃদ্ধি পাওয়া; ক্রস-বর্ডারে ফ্যাক্টরিং বৃদ্ধি; এবং ইউরোপীয় অঞ্চলে ফ্যাক্টরিং সেবার দ্রুত বিকাশ কে ফ্যাক্টরিংয়ে বাণিজ্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে মনে করা হয়।তাছাড়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই)এর বিকল্প অর্থায়ন হিসাবেও বাজারে ফ্যাক্টরিং ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন পরিশোধের প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হচ্ছে ওপেন একাউন্টের মাধ্যমে। International Chamber of Commerce (ICC) কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়,বাজারের গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীরা ওপেন একাউন্টের প্রতি ঝুঁকছে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার আমদানিকারকরা ব্যাপকভাবে লেটার অফ ক্রেডিট (L/Cs) এর পরিবর্তে ক্রমেই ওপেন একাউন্টের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার বাজারেও রপ্তানিকারকদের চাপের কারনে আমদানিকারকরা ওপেন একাউন্টে লেনদেন করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে এলসি পদ্ধতিতে বাণিজ্য করা সময়সাপেক্ষ ও জটিলতানির্ভর। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য এলসি পাওয়া আরো জটিল। তাই বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসার ও আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে মূলধন ঝুঁকিমুক্ত রাখতে বাংলাদেশেও ফ্যাক্টরিং প্রথা চালু করার দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ‘ফ্যাক্টরিং’ খুবই জরুরি। বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে তা খুব দ্রুতই করা উচিত। অর্থাভাবে ব্যবসায়ীরা তৃতীয় পক্ষের কাছে কমিশনে বিক্রি করে দিতে পারলে অর্থঝুঁকি থেকে বাঁচবেন। কারণ,কখনো কখনো তাদের পথে বসে যাওয়ার অবস্থা হয়।
আমাদের পাশ্ববর্তী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত ‘ফ্যাক্টরিং’ ব্যবস্থা চালু করেছে। তবে ‘ফ্যাক্টরিং’ এলসির বিকল্প হতে পারে না। ‘এলসি’ একটি পেমেন্ট পদ্ধতি। ‘ফ্যাক্টরিং’ মূলধন জোগানকারী হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ। উন্নত দেশসমূহ নিজেদের ব্যবসায়ে খরচ কমানোর লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে ফ্যাক্টরিং-এর ব্যবহার করে থাকে। তাই এ দেশে ফ্যাক্টরিং ব্যবস্থা চালু হলে সবেচেয়ে বেশি লাভবান হবে ব্যবসায়ীরা। ফ্যাক্টরিং বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে একটি নতুন ধারণা হলেও বিনিয়োগে অর্থায়নের উৎস হিসেবে এবং ব্যবসায়িক কর্মকান্ড গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর।
বাংলাদেশের আমদানি রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে থাকে এলসির মাধ্যমে। কিন্তু এলসি পদ্ধতিতে বাণিজ্য করা সময়সাপেক্ষ ও জটিলতানির্ভর। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য এলসি পাওয়া আরো জটিল। তাই বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসার ও আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে মূলধন ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ফ্যাক্টরিং প্রথা চালু করার দাবি ব্যবসায়ীদের।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যেক্তা (এসএমই)খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়বে ব্যাপক অবদান রাখছে। রপ্তানি আয়ের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ অবদানই এসএমই খাতের। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ ও উৎপাদন খাতের প্রায় ৪০ শতাংশ এসএমইর অবদান । বেসরকারি খাতের ৯০ শতাংশ এবং অকৃষি খাতের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান হয় এ খাত থেকে। অর্থনীতিতে এ বিশাল অবদানের জন্য তাদের অর্থায়ন সমস্যার বিষয়টিতে বাড়তি নজর দেয়া হলে অর্থনীতি বহুমুখীকরণ ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হতে পারে। বাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ‘ফ্যাক্টরিং’ খুবই জরুরি। বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে তা খুব দ্রুতই করা উচিত। আর ব্যবসায়ীদের পক্ষে বলা হয়, অর্থাভাবে ব্যবসায়ীরা তৃতীয় পক্ষের কাছে কমিশনে বিক্রি করে দিতে পারলে অর্থঝুঁকি থেকে বাঁচবেন। কারণ, কখনো কখনো তাদের পথে বসে যাওয়ার অবস্থা হয়।
ভারত ‘ফ্যাক্টরিং’ আইন চালু করেছে। অনেক দেশেই এতে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। তবে ‘ফ্যাক্টরিং’ এলসির বিকল্প হতে পারে না। ‘এলসি’ একটি পেমেন্ট পদ্ধতি। ‘ফ্যাক্টরিং’ মূলধন জোগানকারী হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ। উন্নত দেশসমূহ নিজেদের ব্যবসায়ে খরচ কমানোর লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে ফ্যাক্টরিং-এর ব্যবহার করে থাকে। ফ্যাক্টরিং ব্যবস্থা চালু হলে সবেচেয়ে বেশি লাভবান হবে ব্যবসায়ীরা। তাই এ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলনের জন্য দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হতে হবে। এ পদ্ধতি আমদানীকারকদের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং ব্যবসার ব্যয় হ্রাসে সহায়ক হবে। ফ্যাক্টরিং বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিম-লে একটি নতুন ধারণা হলেও বিনিয়োগে অর্থায়নের উৎস হিসেবে এবং ব্যবসায়িক কর্মকান্ড গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর। ব্যবসায়ী সমাজ বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক কর্মকা- পরিচালনার জন্য ফ্যাক্টরিং ব্যবস্থা অত্যন্ত উপরকারী ও কার্যকর হতে পারে।
ফ্যাক্টরিং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি একটি অর্থায়ন পদ্ধতি। এটি কাজে লাগানো গেলে এখন দেশের জন্য খুবই উপকারী হবে।ফ্যাক্টরিংয়ের বিষয়ে দেশের ব্যাংকগুলো প্রস্তুত নয়। ফলে রফতানিকারকরা এ সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। আন্তর্জাতিকভাবে সুদের হার এখন অনেক কমে গেছে। কিন্তু দেশে সে হারে কমেনি। এখন কম সুদের বিদেশি ঋণ কাজে লাগাতে পারলে উৎপাদন খরচ কমবে। ফলে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনে সহায়ক হবে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে করোনার প্রভাব মোকাবেলায় রফতানি খাতে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে ফ্যাক্টরিং প্রক্রিয়াকে দ্রুত কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে, এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হলে বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানিকারক দেশগুলোর অর্থের প্রবাহ বাড়বে, যা করোনা মহামারীকে মোকাবেলা করতে সহায়ক হবে।
লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইলঃ ma_masum@yahoo.com