দেশের প্রায় সব ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআই তাদের নিজস্ব ব্যাংক করার চিন্তা করছে। ব্যবসায়ী সংগঠনের ব্যাংক করতে চাওয়াকে বিস্ময়কর বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এফবিসিসিআইকে ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া ঠিক হবে না।
গত রবিবার (২৫ এপ্রিল) এফবিসিসিআই পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। আগামী সপ্তাহে নতুন কমিটি দায়িত্ব নেবে। ব্যাংক করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নতুন কমিটির পর্ষদ। এদিকে অনেক দিন ধরেই সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে এফবিসিসিআইয়ে নেতা নির্বাচিত হন না। সরকার–সমর্থিত ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থে নেতা হয়ে যান। সরকারও এ সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে, এটি ভালো হচ্ছে না।
দেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এফবিসিসিআইকে কোনোভাবেই ব্যাংক দেওয়া ঠিক হবে না। এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ব্যাংক করার ব্যাপারে বোর্ডসভায় প্রাথমিক আলোচনা হলেও নতুন কমিটির সদস্যদের মতামত নিয়ে তারা অগ্রসর হবেন।দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা ব্যবসায়ী সংগঠনকে নতুন করে ব্যাংক না দেওয়ার ব্যাপরে কতগুলো বিষয় বিবেচনা করেছেন।
প্রথমত, বাংলাদেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। তাই এ মুহূর্তে নতুন কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের জন্য আলাদা ব্যাংক দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, এফবিসিসিআইয়ের নেতাদের অনেকেই এখন ব্যাংকের পরিচালক। তাঁরা উদ্যোক্তা–পরিচালক। এখন এফবিসিসিআই নতুন ব্যাংক করলে তাঁদেরই আবার ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে হবে। এতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আপস করতে হবে। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ব্যাংকের পরিচালক বানিয়ে ফেলবেন। এতে ঋণ দেওয়া, ঋণের অর্থ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে।
তৃতীয়ত, এফবিসিসিআইয়ের নেতাদের মধ্যে যাঁরা আগে থেকেই ব্যাংকের পরিচালক, তাঁদের অনেকের ব্যাংকের অবস্থা এখন খারাপ। তাঁরা কেন তাঁদের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ঠিক করছেন না? এখন তাঁরা যদি এফবিসিসিআইয়ের ব্যাংকের পরিচালক হন, তাহলে কীভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে? এমন অবস্থায় এখন আর নতুন করে ব্যাংকের প্রয়োজন নেই।
এখন অনেকেই বলতে পারেন, পুলিশ, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশসহ (বিজিবি) অনেক সংস্থা নিজেদের জন্য ব্যাংক পেয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এসব ব্যাংকের মালিকেরা ব্যবসায়ী নন। এসব সংস্থার সদস্যদের ব্যাংকসেবা পাওয়ার জন্য এ ব্যাংকগুলো করা হয়েছে। তাই বলা যায়, শুধু ব্যবসায়ী সংগঠনের জন্য ব্যাংক দেওয়া সুবিবেচনার কাজ হবে না।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যাংক করার বিষয়ে সবেমাত্র প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। এখনও অনেক পথ বাকি। তিনি জানান, এফবিসিসিআই’র নেতারা যে কোনও ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে পারেন, কিন্তু ব্যাংকগুলো নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না। এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে ওই উদ্যোক্তাদের বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে তদবির করেও কাজ হয় না। যে কারণে ব্যাংক করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যদি ব্যাংক হয়, তা হলে এই ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সহজে ঋণ নিতে পারবেন। সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে ইনসুরেন্সের দরকার হয়। এ কারণে আমরা ব্যাংকের পাশাপাশি বিমা কোম্পানি করার কথাও ভাবছি।
জানা গেছে, সরকারের উচ্চমহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন এফবিসিসিআই-এর শীর্ষ নেতারা। সেখান থেকে ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার পরই পর্ষদ সভায় বিষয়টি তোলা হয়। ব্যাংক ও বিমার পাশাপাশি হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ও দিতে চায় সংগঠনটি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংক বেশি। এফবিসিসিআই-এর জন্য আলাদা ব্যাংক দেওয়ার কোনও মানে হয় না। তার মতে, বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এফবিসিসিআইকে ব্যাংক দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখি না। তাদেরও উচিত হবে না সংগঠনের কাজ বাদ দিয়ে ব্যাংক বাণিজ্য করা। তাদের কাজ হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি যেসব শিল্পখাতে ঋণ যায় না, বা কম যায়, সেসব খাতে ঋণের ব্যবস্থা করা। ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে দাবি আদায়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা।
এ বিষয়ে জানেন না অর্থমন্ত্রী
এদিকে এফবিসিসিআই যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেই বিষয়ে কিছুই জানেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বুধবার (২৮ এপ্রিল) ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এফবিসিসিআই থেকে আমার কাছে কোনও প্রস্তাব আসেনি। এ সম্বন্ধে আমি জানি না।’
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ২০১২ সালে ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে চায়নি। অর্থনীতিবিদরাও এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, রাজনৈতিক কারণে ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে হয়েছে। এরপর একে একে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সীমান্ত ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংক। এ ছাড়া পিপলস ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন।
বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ৬১টি ব্যাংক চালু আছে। এর মধ্যে ৪৩টিই ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান বর্তমানে আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এ কে আজাদ শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক, মীর নাসির হোসেন ইস্টার্ন ব্যাংকের পরিচালক এবং আবদুল আউয়াল মিন্টু ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। এ ছাড়া বিজিএমইএর সাবেক সভাপতিসহ ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংক পরিচালনায় যুক্ত আছেন।
আমরা মনে করি বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকের অবস্থাই খারাপ। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরা সূচনীয়। তাই নতুন করে করে ব্যাংকের অনুমোদন না দিয়ে বর্তমান ব্যাংকগুলোকে সুশাসন ও জবাবদিহীতার আওতায় আনার মাধ্যমে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা উচিত।