ঢাকা শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
করোনার ঝুঁকি এবং অর্থনীতি যোদ্ধাদের হাসিমুখ
  • এম. এ. মাসুম
  • ২০২১-০৪-১৬ ০১:১১:২৪

যারা যুদ্ধ করেন তারাই যোদ্ধা। সাধারণতঃ যোদ্ধা বলতে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, বর্ডার গার্ড, আনসার বাহিনী ইত্যাদিকে বোঝায়। চিকিৎসা যোদ্ধা হচ্ছে ডাক্তার, নার্স আর অর্থ ব্যবস্থার যোদ্ধা ব্যংকার।

করোনা দেশে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিনই আত্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এযবৎকালের রেকর্ড ভংগ করে চলেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে হাসপাতালগুলোতে ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করায় নতুন করে করোনা রোগী নেয়ার অবস্থা নেই। সরকারী হিসাবেই প্রতিদিন প্রায় ১শত জন মৃত্যু বরণ করছেন। এ হিসাব কী শতভাগ সঠিক? অনেকেই হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে বাসা বাড়িতে, রাস্থায় বা ছোট খাট হাসহাপাতালে মৃত্যু বরণ করছেন। তাছাড়া, সবাই করোনা টেস্ট করছেননা অথবা করাতে পারছেননা। অনেকে বলছেন, সে হিসাবে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশী। মোট কথা, করোনা দেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। ফলে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন এবং ১৪ তারিখ থেকে সর্বাত্নক কঠোর লকডাউন ও সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সাধারণ ছুটি ঘোষনা করেছে।

করোনার এই মহাদুর্যোগে ব্যাংক যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেটা গত ১৩ তারিখ অনেকেই অনুধাবন করতে পেরেছেন। সরকার প্রজ্ঞাপন জারী করে দেশের সকল সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সাধারণ ছুটি ঘোষনা করেছে। মানুষজনকে একান্ত বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত ঘরবন্দী থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু খোলা আছে ব্যাংক। প্রথম দিকে ব্যাংক খোলা থাকবে কিনা তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষ করা যায়। প্রথমে তারা মনে করেছিলেন সর্বাত্নক লকডাউনের আওতায় ব্যাংকও বন্ধ থাকা উচিত। পরবর্তীতে সে সিদ্ধান্ত  থেকে সরে এসে ব্যাংক খোলার সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্যাংক যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবার তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল। একটা সত্য বেরিয়ে এল, দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ব্যাপারে সরকারকে যতটুকু ভাবতে হয় ব্যাংক বন্ধের ব্যাপারে তার চেয়ে অনেক বেশী ভাবতে হয়। আমরা হয়ত অনেকেই বিষয়টি সেভাবে নিয়ে সেভাবে চিন্তা করিনা। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, করোনাকালীন সময়ে ব্যাংক আর ব্যাংকার আপনার কি কাজে লাগে? অনেকেই হয়ত এককথায় উত্তর দিয়ে দেবেন, করোনাকালীন এই সময়ে ব্যাংকারদের আবার কোন কাজে লাগে?

ঈদ, পুজা, নির্বাচন কিংবা যে কোন কারণে যদি লম্বা সময়ের জন্য ছুটি হয়, অনেক চাকরিজীবী, পেশাজীবী নিজ গ্রামে আপনজনদের কাছে চলে যান। কিন্তু লম্বা ছুটির মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্যের যাতে সমস্যা না হয় কিংবা কেউ যাতে অর্থ সমস্যায় না পড়ে, সেই জন্য লম্বা ছুটির মধ্যেও অনেক সময় ব্যাংক খোলা থাকে। এমনকি বছরের বিশেষ দিন যেমন সব-ই-বরাত এর দিনেও ব্যাংক খোলা থাকার নজির আছে। ব্যাংক খোলা থাকার কারণে ব্যাংকাররা তখনও নিজের আপনজনের কাছে না যেয়ে, কর্মস্থলে থেকেই মানুষকে সেবা দিয়ে যান। সরকারের ঘোষিত দায়িত্ব যদি ব্যাংকারদের উপর এসে পড়ে, তবে তারা সেটা সুশৃঙ্খল ভাবে করে থাকে।

দেশের অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে ব্যাংকারা অকোতভয়ে অর্থ ব্যবস্থার যোদ্ধা হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। রাস্তায় চলাচলের জন্য যানবাহন না থাকলেও অনেকে পায়ে হেঁটেই কর্মস্থলে যাতায়াত করছেন। বর্তমান এই করোনাকালে সাধারণ মানুষ যেন অর্থ কষ্টে না পড়ে, ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম যেন স্থবির হয়ে না পড়ে, সেজন্য ব্যাংকগুলো নির্দেশনা মোতাবেক সীমিত পরিসরে প্রতিদিনই তাদের কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কাজের জন্য ঝুঁকি রয়েছে, তারপরেও ব্যাংকাররা মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। করোনার ভয়ে কোন ব্যাংক কর্মকর্তা কোন গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবা দিতে রাজি হননি, এমন রেকর্ড এখনও আমরা দেখিনি। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যত গ্রাহকই শাখায় আসছেন, তারা সকলেই সেবা পাচ্ছেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের রাস্তায় বের হতে হচ্ছে। 

ব্যাংকগুলোতে দেখা যাচ্ছে উপচে পড়া ভিড়। ঠাসাঠাসি করে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে গ্রহীতাদের। শাখায় আগতরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিধি না মেনেই ঢুকে পড়ছেন। কে শুনে কার কথা। বিগত দিনের লকডাউনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করা যায়, ব্যাংকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে ব্যাংকারদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকারের মৃত্যুর সংবাদ শুনতে হয়েছে। ঠিক কত সংখ্যক ব্যাংকার মৃত্যু বরণ করেছেন তা বাংলাদেশ ব্যাংক বা কোন সংস্থা প্রকাশ করেনি। তবে বিভিন্ন গণ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা যায় শতাধিক ব্যাংকার করোনায় মৃত্যু বরণ করেছেন। শুধুমাত্র এ বছর মার্চের শেষ দিক থেকে আজ  পর্যন্ত অন্ততঃ ১৫-২০ জন ব্যাংকরের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্ত হয়েছেন কতজন তার কোন পরিসংখ্যান নেই। ব্যাংক কর্মীরা ব্যাপকহারে আক্রান্ত হলে তার দায় কে নেবে? তাদের পরিবার পরিজনদের মধ্যেও উৎকন্ঠা বেড়ে গেছে।  

সরকারী ছুটি ভোগ করা রাষ্ট্রের প্রত্যেক সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীর অধিকার। রাষ্ট্রের বিশেষ প্রয়োজনে সরকারী ছুটির দিন অফিস করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীদেরকে ছুটির দিনের জন্য বিশষ ভাতা প্রদান করা হয়ে থাকে। দেশে চলমান সাধারণ ছুটির আওতায় ব্যাংকারা কাজ করলে কোন ভাতা পাবেন কিনা তা বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করেনি। ব্যাংকাররা মনে করেন, তারা যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটির দিন অফিস করছেন তার অন্ততঃ আর্থিক মূল্য থাকা উচিত। তা না হলে বিষয়টি অত্যন্ত অমানবিক হবে বলে মনে করেন ব্যাংকার ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা।

দেশের যে কোন মহাদুর্যোগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ডাক্তার ও অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি সকল ব্যাংকার সবসময় প্রস্তুত থাকেন। তারা তাদের নিজের সীমাবন্ধতা, সমস্যা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অসুবিধা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা ইত্যাদি অপ্রকাশিত রেখে এবং নানাবিধ মানষিক চাপ নিজের মধ্যে রেখে প্রতিদিন হাসিমুখে সেবা দিয়ে থাকেন।করোনাকালী দেশের এ মহা ‍দুর্যোগ মুহূর্তে অর্থনীতির এ যোদ্ধারা যেন মান সম্মান বজায় রেখে এবং সুস্থতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারেন এ আশা ব্যক্ত করছি। সেসাথে ছুটির অবসর ত্যাগ করে যে ব্যাংকাররা কাজ করে যাচ্ছেন তাদেরকে অন্ততঃ আর্থিকভাবে পুরস্কিৃত করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে দৃষ্টি দিবেন সেটাও প্রত্যাশা করছি।

লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইমেইলঃ ma_masum@yahoo.com

বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামের শেষে ‘পিএলসি’, সুবিধা-অসুবিধা
পদোন্নতি হলোনা, কি করবেন
রাশিয়ার উপর নিষেধজ্ঞায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে প্রভাব