বিদায়ী বছরের সংকটের কথা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। করোনা নামক এক ভাইরাসের কবলে পড়ে তছনছ হয়ে গেছে সব হিসাব–নিকাশ। বছরের বেশির ভাগ সময় ঘরবন্দী ছিল মানুষ। জীবনের টানে জীবিকাকে পিছিয়ে রাখায় থমকে ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফলস্বরূপ দেশে দেশে সংকুচিত হয়েছে অর্থনীতি। অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, কমেছে আয়। তবে এর মধ্যে অদ্ভুত আচরণ করেছে বৈশ্বিক শেয়ারবাজার। সাধারণত বৈশ্বিক পরিস্থিতি খারাপ হলে পুঁজিবাজারেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আসলে শেয়ারবাজারের নিজস্ব একটি জগৎ আছে। যেখানে বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ দেখেন। নতুন আশা করেন। সেইসঙ্গে প্রযুক্তি খাতের শেয়ারের উত্থান, জুয়াড়িদের বাজি —এ সবকিছুই ইতিবাচক রেখেছিল শেয়ারবাজার।
করোনায় অন্যতম বিপর্যস্ত দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বছরের প্রথম অংশ বাদে বাকি সময় চাঙা ছিল ওয়াল স্ট্রিট। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিভিত্তিক সূচক নাসডাক বেড়েছে ৪২ শতাংশ। অপর আরেকটি সূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০ বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
করোনার ছোবলে জর্জরিত যুক্তরাজ্যের পুঁজিবাজার অবশ্য অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলেছে। বিদায়ী বছরে এফটিএসই ১০০ সূচক কমেছে ১৪ শতাংশ। অবশ্য প্রথমে যেভাবে সূচক কমছিল, পরের কয়েক মাস সে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। উত্থানেই ছিল সূচকটি। একই অবস্থা ভারতের শেয়ারবাজারেও। অর্থনৈতিক সংকোচনের মুখেও দেশটির শেয়ারবাজার গত শুক্রবার রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বিনিয়োগ বেড়েছে, রমরমা প্রযুক্তি খাতে কোম্পানিগুলো
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজারের এই চাঙাভাবের পেছনে বাজারের নিজস্ব নিয়ম যেমন কাজ করেছে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের অতি উৎসাহও কাজ করেছে। এতে বিনিয়োগ বেড়েছে বাজারে। গত বছরের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত—যেমন: ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নোট ছেপে ৮৯৫ বিলিয়ন ইউরোপর সরকারি ও করপোরেট বন্ড কেনা, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের তিন লাখ কোটি ডলারের সম্পদ কেনা—বাজারে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। মার্কিন সরকারের এই বড় অঙ্কের বিনিয়োগের কারণে ব্যাংকঋণের সুদহার কমেছে। আর নতুন এই অর্থ বন্ডে বিনিয়োগ করা হলেও বাজারের সবখানেই তার প্রভাব অনুভূত হয়। মূল্যবৃদ্ধি হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নোট ছাপার কারণে তারল্য বেড়ে যায়। এতে আর্থিক সম্পদের মূল্য বেড়ে যায়। সে কারণেই বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে এই তেজিভাব।
মার্কিন সূচক নাসডাক বৃদ্ধির কারণ হলো মহামারির মধ্যে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাড়বাড়ন্ত। মহামারির মধ্যে মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। কেনাকাটা, অফিস, বাচ্চাদের স্কুল, মিটিং, সম্মেলন সবই হয়েছে অনলাইনে। অনলাইনে খুচরা বিক্রির পরিমাণ আকাশ ছুঁয়েছে। বেড়েছে প্রযুক্তি যন্ত্রের ব্যবহার। ই-কমার্স জায়ান্ট জেফ বেজোস ও বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি টেসলা ও স্পেসএক্সের মালিক এলন মাস্কের সম্পদ ফুলেফেঁপে উঠেছে। বর্তমানে শীর্ষ ধনী এলন মাস্কের সম্পদের পরিমাণ ২০২০ সালেই কেবল বেড়েছে ১৬ হাজার কোটি ডলার। মূলত, তাঁর কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েই এত সম্পদ।
নাসডাকে অন্তর্ভুক্ত গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, আমাজন ও ফেসবুকের সম্মিলিত মূল্য বাকি ৯৫ শতাংশ কোম্পানির সমপরিমাণ। ফলে, নাসডাক সূচক দেখলে মনে হবে না, যুক্তরাষ্ট্রে করোনা বলে কিছু আছে। বড় বড় কোম্পানির দাপটের সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়। সেটা হলো অক্রিয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। পেনশনধারী, অর্থ ব্যবস্থাপক ও সন্দেহভাজন বিনিয়োগকারীরা অল্প সুদে তহবিল থেকে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই এই জাতীয় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়লে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের দামও বেড়ে যায়।
বিশ্লেষকেরা বলেন, গত ১০ বছরে সক্রিয় হিসাব থেকে অক্রিয় হিসাবে টাকা স্থানান্তরের হার অনেক বেড়ে গেছে। মহামারিতে তার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।
জুয়াড়িদের ভূমিকা
এ ছাড়া জুয়াড়িদের একটা ভূমিকা আছে। বাজার চাঙা হওয়ার পক্ষে তাঁরা এখন বেশি বাজি ধরছেন। ২০১২ সালের পর জুয়াড়িদের বাজার নিয়ে এতটা আশাবাদী হতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া ২০২০ সালে যাঁদের চাকরি টিকে গেছে এবং নানা কারণে আয়ও বেড়েছে, তাঁরাও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। সরকারগুলো কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে কিছু মানুষের হাতে বিনিয়োগযোগ্য টাকা জমছে।
গেমিং কোম্পানির শেয়ার
লকডাউনের মধ্যে ঘরে বসে অনলাইনে গেমস খেলার প্রবণতা বেড়েছে মানুষের। এতে লাভ বেড়েছে কোম্পানিগুলোর। জাপানের বেশ কিছু গেমিং কোম্পানি শেয়ারবাজার এসেছে।
প্রকৃত অর্থনীতির সংকোচনের মুখে বিশ্ব শেয়ারবাজারের এই উত্থান বিশ্লেষকদের বেশ কৌতূহল জাগাচ্ছে। কিছু কোম্পানির ভালো ব্যবসা হয়েছে। মানুষও সেদিকে ধাবিত হয়েছে। আসলে শেয়ারবাজারের নিজস্ব একটি জগৎ আছে। যেখানে বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ দেখেন। নতুন আশা করেন। ২০২১ সালে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলেই এখন বিশ্বাস মানুষের। সেই ভরসায় হয়তো এই বিনিয়োগ বৃদ্ধি।