ঢাকা শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
কে শুনছে অসহায় অভিবাসী বা শরণার্থীর আর্তনাদ?
  • মালবী গুপ্ত
  • ২০২০-১২-২৩ ১১:৪১:২০

”মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও/ মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও।”

মনে হচ্ছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওই অমোঘ নির্দেশকে মান্যতা দিয়ে যদি সত্যি ক্রন্দনরত মানুষের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারতাম।

মনে হচ্ছে, যুদ্ধদীর্ণ, জাতি দাঙ্গা বা গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে বা রাজনৈতিক সন্ত্রাসে মৃতপ্রায়, কখনো দারিদ্র কিম্বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভিটে হারানো যারা হন্যে হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে একটু নিরাপত্তা খুঁজে চলেছে, যদি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারতাম।

কিন্তু পারছি কই? আর এই না পারার বিষাদ অনুভূতিই যেন বেশি করে সংবাদ মাধ্যমে বারবার উঠে আসা সেইসব আতঙ্কিত মুখগুলিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। যারা নিজভূমেই নিয়ত ছিন্নমূল হয়ে গ্রাম ছেড়ে, শহর ছেড়ে, কখনো বা দেশ ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে পালাচ্ছে।

চোখের সামনে আজ ভেসে উঠছে, তুরস্কের সাগর তীরে বালির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সেই হৃদয়বিদারক বছর তিনেকের সিরিয়ান শিশু আলান কুর্দির নিথর দেহও। ভূমধ্যসাগরের নৌকাডুবি আরও অনেকের সঙ্গে যে শিশু প্রাণটিও কেড়ে নিয়েছিল।

ইউরোপে আশ্রয়ের খোঁজে বছর চারেক আগে সিরিয়া থেকে জলপথে পালানো পরিবারের সঙ্গে থাকা আলানের সেই প্রাণহীন দেহ যেন সেদিন কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা পৃথিবীকে।

তবে প্রতিদিনই এখন এমন অসংখ্য আলান, অসংখ্য পরিবারের সলিল-সমাধি ঘটছে। প্রতি মুহূর্তের বিপদসংকুল বাঁচা থেকে পরিত্রাণ পেতে, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়াচ্ছে যে হাজার হাজার অভিবাসী ও শরণার্থী, তাদের অনেকেরই মাঝপথে মৃত্যু ঘটে যাচ্ছে।

জানতে পারছি ওই সাগর পেরোতে গিয়ে কেবল ২০১৮ তেই প্রতিদিন ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মনে পড়ে যাচ্ছে ক্রন্দনরত শিশুদের সেইসব অসহনীয় মুখও। বিগত কয়েক মাস ধরে আমেরিকায় পৌঁছনো শরণার্থী মা-বাবার কাছ থেকে যাদের জোর করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে। এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই যে শিশুর কপালে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশহীন রাষ্ট্রহীন নাগরিকত্বহীনের টিকা।

কে জানে হয়তো তাদের উত্তরসূরিদের পিঠেও পুরুষানুক্রমে লেগে থাকবে সেই অপরিচয়ের গ্লানি, যে গ্লানির মধ্যে এক অনিঃশেষ অসহায়তা থেকে যাবে। হয়তো প্রাণের আশঙ্কাকেও তাদের আমৃত্যু লালন করে যেতে হবে।

এবং এই অভিবাসী ও শরণার্থীর প্রতি আমেরিকায় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে নিতান্ত শিশুদেরও যেভাবে বাবা মা’র থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তাকে মনে হয় যেন মানবসভ্যতার চরমতম অমানবিকতার নিদর্শন বললেও বুঝি কম বলা হয়।

আজ জীবন-মৃত্যুর এই দোলাচলে থাকা, সন্তান – স্বজন হারানো দেশান্তরী সেইসব লক্ষ লক্ষ মানুষের কান্না কে মোছাবে? চরম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই কোটি কোটি আশ্রয়হীনের পাশে একাকী মানুষ কীভাবেই বা দাঁড়াবে?

 

আসলে মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়েই যেন ঘোর এক অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আমরা কেবলই ঘুরে মরছি।

জাতিসঙ্ঘের রিফিউজি এজেন্সির ২০১৮ এর রিপোর্ট বলছে, সারা বিশ্বে ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ মানুষ বাধ্য হয়েছে, ওই যুদ্ধ-জাতি-গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঘর ছেড়ে পালাতে আশঙ্কা হচ্ছে ২০১৯-এ ওই সংখ্যা যে কত গিয়ে দাঁড়াবে তাই ভেবে । কারণ একদিকে খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি তথা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত দরিদ্র মানুষ। অপরদিকে হিংসা, সংঘাতে জর্জরিত মানুষ।

সে সিরিয়া সুদান সোমালিয়া ইয়েমেনই হোক, বা ভারত বাংলাদেশ মায়ানমার আফগানিস্তান কিম্বা মেক্সিকোই হোক – সর্বত্রই হাজারে হাজারে যারা ক্রমাগত নিরাশ্রয় হয়ে পড়ছে। ছিন্নমূল শরণার্থী হয়ে দেশান্তরে ছুটে যাচ্ছে। আশ্রয় খুঁজছে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার নানা দেশে।

কোথাও কোথাও অস্থায়ী ঠাঁইও জুটেছে, জুটছে। আবার কেউ কেউ দেখছি তাদের ওই অসহায়তার সামনেই আকাশ উঁচু পাঁচিল তুলে দিতে চাইছে এবং দিচ্ছে।

অথচ প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন করে, আর প্রতি মিনিটে ৩০ জন মানুষ নতুন করে আশ্রয়চ্যুত হচ্ছে।এবং সারা পৃথিবীতে প্রতি ১১০ জন মানুষে একজনকেই হয় আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে, নয় দেশের মধ্যেই তাকে স্থানান্তরিত কিম্বা উদ্বাস্তু হতে হচ্ছে।

কে বলতে পারে আজ বা কাল আমরাও ওই ১১০ জনের একজন হব না। কে বলতে পারে কোনো যুদ্ধ বা কোনো ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদেরও ছিন্নমূল করবে না।

কারণ বিশ্ব জুড়েই এক গভীর অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা যেন কেবলই আমাদের গ্রাস করছে। মনে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে, এক অদ্ভুত আক্রোশে যেন মানুষই সেই সভ্যতা দু’হাতে নিরন্তর গুঁড়িয়ে চলেছে।

মনে হচ্ছে মানুষই যেন মানুষের জন্য নিরবধি এক অনন্ত ফাঁদ পেতে চলেছে। এবং সেই অদৃশ্য মৃত্যু ফাঁদ যাকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলছে, তার সমস্ত মানবাধিকারও সে কেড়ে নিচ্ছে চরম নিষ্ঠুরতায়।

তাই ভাবছি কে কার পাশে দাঁড়াবে? কারণ যে প্রতিবেশী, সে ব্যক্তি হোক বা রাষ্ট্র, ‘পাশে আছি’ বলে কখনো কখনো যে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, সেই হাতের রঙও যে প্রায়শই বদলে বদলে যাচ্ছে!

যে হাতের বরাভয়ে একদিন ক্রন্দনরত অসহায় মানুষ আশ্রয়ের নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে, সেই হাতের মুদ্রাও হঠাৎই বদলে যাচ্ছে যেন। সেই মুদ্রায় উঠে আসছে হুঁশিয়ারি। কখনো গ্রামে ফিরতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি, দেশে ঢুকতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি, কখনো বা দেশ থেকে বিতাড়নেরও হুঁশিয়ারি।

তাই ভাবছি, রাষ্ট্রহীন নাগরিকত্বহীন, সমস্ত মৌলিক অধিকার বঞ্চিত, অহরহ মৃত্যুভয়তাড়িত যাদের জীবন যাপন, যাদের অপরিচয়ের অসহায়তা নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে দেশ থেকে দেশান্তরে এক অনিঃশেষ যাত্রা, তাদের প্রতি আমরা কি একটুও সহমর্মী, একটুও সহানুভূতিশীল হতে পারছি?

নাকি নিজেদের জীবন-যাপন নিয়ে আমরা এতটাই এখন মশগুল, যেখানে ওই লক্ষ লক্ষ মানুষের কান্নার কোনো অভিঘাতই পৌঁছচ্ছে না? –বিবিসি।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামের শেষে ‘পিএলসি’, সুবিধা-অসুবিধা
পদোন্নতি হলোনা, কি করবেন
রাশিয়ার উপর নিষেধজ্ঞায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে প্রভাব