খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। তবে এ ঋণের বিপরীতে ধার্য্যকৃত সুদ আয় হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা স্ফীত হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে কৃত্রিম আয়। আর এ আয় থেকে সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সরকারকে কর দিতে হচ্ছে। বাকি অর্থের বড় একটি অংশ নগদে ডিভিডেন্ড আকারে ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র আড়াল হয়ে যাচ্ছে। দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি। ব্যাংকগুলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ড নির্দেশনা লঙ্ঘন ও ব্যাংকিং খাতে সার্বিক ঋণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পুনঃতফসিলকৃত ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ছাড়া কোনোভাবেই তা আয় খাতে নেয়া যাবে না। কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, কোনো ঋণখেলাপি হয়ে গেলে তিন ধাপে তা নবায়ন করা যাবে। প্রত্যেকবার নবায়নের জন্য আলাদা আলাদাভাবে ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে।
খেলাপি ঋণের ধরনভেদে ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো ঋণ নিম্নমানে খেলাপি হলে ওই ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এর পরও আদায় না হলে সংশ্লিষ্ট ঋণ সন্দেহজনক খেলাপি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এ সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর ৫০ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এরপরও কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলে নির্ধারিত সময় শেষে ওই ঋণ মন্দ বা কু-ঋণে চলে যাবে। এ কু-ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় করার জন্য গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করে থাকে। আর কু-ঋণ যতদিন আদায় না হয় ওই ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। এ কারণে খেলাপি ঋণ যে ব্যাংকের যত বেশি ওই ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় বেশি হারে। আর বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে যায় ব্যাংকের পরিচালন ব্যয়।
খেলাপি ঋণের বিপরীতে ধার্যকৃত সুদ আয় খাতে নেয়া যায় না। তা আলাদা হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। যখন খেলাপি ঋণ আদায় হয়, তখন তা আয় খাতে নিতে পারে ব্যাংকগুলো। একই সাথে পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের বিপরীতেও অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া যায় না। যখন যেটুকু আদায় হবে, ওইটুকুর বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, খেলাপি ঋণের কারণে কোনো ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল না হয় তা রোধ করাই ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নির্দেশনা দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কর্মকর্তারা দেখতে পেয়েছেন, কোনো কোনো ব্যাংক নবায়নকৃত ঋণের কিস্তি আদায় না করেই ওই ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ঋণ আদায় না হলে যেখানে ধার্যকৃত সুদ আলাদা হিসেবে রাখার কথা, সেখানে ধার্যকৃত সুদ সরাসরি আলাদা না রেখে সরাসরি আয় খাতে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে কিছু ব্যাংক জালজালিয়াতির মাধ্যমে আয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর কৃত্রিম আয়ের বিপরীতে ব্যাংকগুলো সরকারের সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সরকারকে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করছে। পাশাপাশি বাকি কৃত্রিম আয়ের একটি অংশ ডিভিডেন্ড আকারে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করছে। এভাবেই ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লঙ্ঘনের শামিল। শুধু তাই নয়, ব্যাংকিং খাতে সার্বিক ঋণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোরভাবে ব্যাংকগুলোর সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একই সাথে ব্যাংকগুলোর মূলধন সুসংহতকরণ প্রয়োজন। এ জন্য ব্যাংকিং খাতে সার্বিক ঋণ শৃঙ্খলার স্বার্থে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ছাড়া কোনোভাবেই ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ৪৫ ধারা ক্ষমতাবলে গতকাল এ নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ, নতুন শাখার খোলা স্থগিত রাখা ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হয় এমন শাখার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে।