নথিপত্রে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়নি।
করোনার কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলে যখন সাধারণ ছুটি চলছিল, তখনো ব্যাংকগুলো খোলা ছিল। ঠিক ওই সময়ে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা ‘স্বেচ্ছায়’ চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর বছরজুড়ে ব্যাংকারদের চাকরি ছাড়া অব্যাহত ছিল,যা চলতি বছরেও অব্যাহত রয়েছে।
একই সময়ে অনেক ব্যাংক ব্যাংকারদের বেতনও কমিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বেসরকারি ছয়টি ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ওঠে এসেছে, নথিপত্রে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ কর্মকর্তাকে তা করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া’র ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কোথাও কোথাও কারণ দর্শানো নোটিশ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগও দেওয়া হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের চাকরির সুরক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে যাতে ব্যাংক ছাড়তে না হয়, এ বিষয়ে নির্দেশনা দেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। পাশাপাশি অপসারণ, বরখাস্ত ও ছাঁটাইয়ের বিষয়েও নির্দেশনা দেবে। ফলে ব্যাংকগুলো আর ব্যাংকারদের ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগে বাধ্য করতে পারবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কর্মীদের কারণে করোনার মধ্যে ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। এরপরও অনেককে অকারণে কর্মী ছাঁটাই করেছে। এর ফলে পুরো ব্যাংক খাতের কর্মীরা আতঙ্কে ভুগছেন, যা দূর করতে শিগগিরই নির্দেশনা দেওয়া হবে।
ছাঁটাই হওয়া কয়েকজন ব্যাংকার জানান, বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আবার সিনিয়র পদে নতুন কেউ যোগ দিলেও পুরোনোদের ছাঁটাই করে নতুন লোকবল নেওয়া হয়। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে বরখাস্ত বা ছাঁটাই করা হয়। যে কারণে আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায় না, অন্য ব্যাংকে যোগদানের সুযোগও থাকে না। তাই সবাই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৯ আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারি ওই ছয় ব্যাংকের ৩ হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন ৩ হাজার ৭০ জন। আর ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই, ২০১ কর্মকর্তাকে অপসারণ ও ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
আলোচ্য সময়ে ইস্টার্ন ব্যাংকের ২০১, সিটি ব্যাংকের ১ হাজার ৯৮, ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের ২৭৯, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৩৫, ব্র্যাক ব্যাংকের ১ হাজার ২১১ ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৪৬ কর্মকর্তা ‘স্বেচ্ছায়’ চাকরি ছেড়েছেন। এই সময়ে ডাচ্–বাংলা ব্যাংক ১৪১ ও ব্র্যাক ব্যাংক ৪৩ কর্মকর্তাকে অপসারণ করেছে। এত কর্মকর্তার ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগকে অস্বাভাবিক বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সময়ে কোনো কোনো ব্যাংকের ১০-২০ শতাংশ কর্মী ব্যাংকে ছাড়েন।
‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করা কিছু কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের জানান, তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আর ছাঁটাই, অপসারণ ও বরখাস্ত করা কর্মকর্তাদের নথিপত্র যাচাইয়েদেখা গেছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করো হয়নি। কারণ দর্শানো নোটিশ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে ৫-৬ শতাংশ কর্মী প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যান, এটা স্বাভাবিক। এর বেশি হলে অস্বাভাবিক। এটা দেখা দরকার, কেন এমন হলো। আমাদের ব্যাংকের ৩৫-৩৬ জন চাকরি ছেড়েছেন। যাঁরা ভালো করতে পারেননি, তাঁদের আমরা ৩-৫ মাস সময় দিয়েছিলাম, তাঁরা চাকরি পেয়ে চলে গেছেন।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি আনতে ও ব্যাংক খাতকে কর্মিবান্ধব করতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলোর এমন আচরণ বন্ধে একটি নির্দেশনা জারি করা সময়ের দাবি।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে যাঁরা চাকরি ছেড়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ নতুন কর্মী। তাঁরা কেউ অন্য ব্যাংকে বা অন্য চাকরিতে চলে গেছেন। কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে যৌক্তিক কারণে।’
গত বছরের অক্টোবরে প্রাইম ব্যাংক এক ক্যানসার আক্রান্ত কর্মকর্তাকেও পদত্যাগে বাধ্য করে, যিনি ব্যাংকটির একটি বিভাগের প্রধান ছিলেন। এ নিয়ে তিনি গভর্নরের কাছে লিখিত অভিযোগে করেছেন। বিষয়টি ওই সময়ে ব্যাংককর্মীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল।