বছর খানেক আগেও ঋণের সুদহার কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপ ছিল। করোনার কারণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ব্যাংকগুলো এখন কম সুদে তহবিল খাটানোর জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অধিকাংশ ব্যাংকের হাতে তারল্য উপচে পড়ছে। সরকারকে ঋণ, কলমানি, আন্তঃব্যাংক রেপোসহ কিছু ক্ষেত্রে অনেক কম সুদে ঋণ দিচ্ছে তারা। বাড়তি তারল্য ফেলে না রেখে গত ২৮ জুন ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ সুদে এক হাজার ৫৫০ কোটি টাকা খাটিয়েছে দুটি ব্যাংক।
ব্যাংকাররা জানান, কমে যাওয়ার প্রবণতার মধ্যে আন্তঃব্যাংক কলমানি ও আন্তঃব্যাংক রেপোতে ইতোমধ্যে সর্বনিম্ন সুদহারের সীমা ঠিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর কলমানিতে সুদহার সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশে নামার পর ওইদিন মৌখিকভাবে কলমানিতে বার্ষিক ১ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয় আন্তঃব্যাংক রেপোতে (সিকিউরিটিজ জমা রেখে স্বল্প সময়ের জন্য ধার) বার্ষিক শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ ঠিক করে। এরপর থেকে বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন সুদেই আন্তঃব্যাংকে লেনদেন হচ্ছে। ট্রেজারি বিল বন্ডেও সুদহার ব্যাপক কমেছে। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তত গ্রাহকদের আমানতে সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক নির্দেশনার মাধ্যমে এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর করোনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার দেড় শতাংশ কমানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য ৬০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল দেওয়া হয়। তবে আশানুরূপ ঋণ চাহিদা নেই। ফলে অধিকাংশ ব্যাংকের হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত তহবিল পড়ে আছে। গত এপ্রিল শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গেল অর্থবছরের শেষ দিন গত বুধবার গড়ে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ সুদে কলমানিতে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধার দেয় ব্যাংকগুলো। ওইদিন সর্বনিম্ন সুদহার ছিল ১ এবং সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে কলমানিতে দৈনিক গড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হচ্ছে। এর আগে সর্বনিম্ন সুদহারের সীমা ঠিক করে দেওয়ার আগের দিন গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর গড়ে ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ সুদে ৭ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
কয়েকজন ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তঃব্যাংকে সুদহার এভাবে কমায় অনেক ব্যাংক এখন আর গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যদিও ভালো বিকল্প না থাকায় নিরুপায় হয়ে ব্যাংকেই টাকা রাখছেন গ্রাহকরা। গড় মূল্যস্টম্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও আমানতে এর অনেক কম সুদ পাচ্ছেন গ্রাহক। পুরাতন সঞ্চয়সহ আমানতে ব্যাংকগুলোর গড় সুদহার গত এপ্রিলের ৪ দশমিক ৩৬ থেকে কমে মে মাসে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশে নেমেছে। এক বছর আগে যা ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ ছিল। আর মে মাসে ঋণে গড় সুদহার রয়েছে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছরের মে মাসে যা ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ ছিল।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, সুদহারের বিষয়টি চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। বেসরকারি খাতের চাহিদাও কম রয়েছে। এতে করে বাজারে প্রচুর তারল্য রয়েছে। এ সময়ে যেসব ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে, তারা কম সুদে হলেও টাকা খাটানোর চেষ্টা করছে। আবার যেসব ব্যাংকে এসএলআর সংরক্ষণের জন্য বিল-বন্ড দরকার, তারাও যত কম সুদই হোক সেখানে টাকা খাটাচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। আবার আমদানিও বাড়ছে। আবার ঋণ সস্তা হওয়ায় অনেকে শিল্প স্থাপন, বাড়ি কেনা বা নতুন বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিতে আসবে। এতে করে আগামীতে সুদহার কমার প্রবণতা থেমে যাবে।