বৃহৎ ঋণ বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়েই গ্রাহকদের অনুকূলে শতভাগ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু অনীহা ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে। নানা কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে পার হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেয়া ব্যাংকগুলোর চার দফার বর্ধিত সময়ও পার হয়ে গেছে। পার হয়েছে বছরও। কিন্তু ঋণ বিতরণের তিন মাসের লক্ষ্যমাত্রা আজও অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ৭৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৩টিই তাদের বেঁধে দেয়া ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। সর্বশেষ বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলোর এমডিদেরকে ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদেরকে এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত বছর এপ্রিলে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। প্রথমে ৩১ আগস্টের মধ্যে ঋণ বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণ না করায় সময় বাড়িয়ে ৩১ অক্টোবর করা হয়। এ সময়ের মধ্যেও ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হলে ঋণ বিতরণের সময়সীমা আবারো বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তৃতীয়বারেও ঋণ বিতরণে ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আবারো তিন মাস সময় বাড়িয়ে ৩১ মার্চ নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। সর্বশেষ আরো তিন মাস সময় বাড়িয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত পুনর্নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বশেষ তথ্য মতে, গত ১২ মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৭৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। ৬৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ ব্যাংকগুলোকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। এ সময়ের মধ্যে ব্যর্থ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিদের ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর এমডিদের এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৃহৎ ঋণ বিতরণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে শর্তগুলো দেয়া হয়েছে, বড় উদ্যোক্তারা সহজেই ব্যাংকগুলোকে তা সরবরাহ করতে পারছে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক চাপও থাকে বড় ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যবসায়ী। এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের মধ্যে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতার কারণে তারা সহজেই ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ অনুমোদন পাওয়ার সাথে সাথেই তা বিতরণ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, বৃহৎ ও সেবা খাতে ঋণ বিতরণের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দুই দফা বাড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এর প্রায় শতভাগ ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
এ দিকে, বৃহৎ ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো যতটা আগ্রাহ দেখাচ্ছে, ক্ষুদ্র ও কুটির ঋণ বিতরণেই ততটা অনাগ্রহ দেখানো হচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি হয়। এ কারণেই ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে অনীহা দেখাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে। তবে, ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করতে হবে শুধু উৎপাদনশীল খাতে। ট্রেডিংয়ে বিতরণ করা যাবে না। ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র ঋণ উদ্যোক্তাদের বেশি ব্যাংকিং হয় ট্রেডিংয়ে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বিতরণ করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী যতগুলো কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে হয় তা চাহিদা অনুযায়ী উদ্যোক্তারা সরবরাহ করতে পারছে না। এর ফলে অনুমোদন বেশি হলেও বিতরণ হচ্ছে ধীর গতিতে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের জন্য যে চার দফা সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার সর্বশেষ সময় গত মার্চে পার হয়ে গেছে। পঞ্চমবারের মধ্যে ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাই ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দিয়ে আসছে।
প্রসঙ্গত, করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ বিতরণে জন্য সরকার সুদহারের ওপর ভর্তুকি দেয়ার ঘোষণা করে প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়। ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও এসএমই ঋণ বিতরণ করলে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সুদ পাবে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৪ শতাংশ দেবে গ্রাহক ও বাকি ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে। আর সেবা ও বৃহৎ শিল্পে ঋণ বিতরণে ৯ শতাংশ সুদের মধ্যে সাড়ে ৪ শতাংশ গ্রাহক পরিশোধ করবে এবং বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সরকার ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি দেবে। একই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ কর্মসূচির আওতায় কেউ ঋণ বিতরণ করলে তার ৫০ ভাগ ব্যাংকগুলোকে তহবিল জোগানোর ঘোষণা দেয়া হয়।