ঢাকা সোমবার, মে ৬, ২০২৪
করোনায় স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকের আয় কমেছে
  • ব্যাংকবীমাবিডি
  • ২০২১-০৪-৩০ ০২:২১:৪৮

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতে।

সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয় কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে মূলধন থেকে আয়। ঋণের সুদ থেকেও আয় কমেছে। আয় কমলেও লাগাম পড়েনি ব্যয়ে। বেড়েছে ব্যয়ের পরিমাণ। এর মধ্যে ঋণের সুদ থেকে আয়ের একটি বড় অংশই শুধু খাতা-কলমে। বাস্তবে আদায় হয়নি।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার প্রভাবে একদিকে ব্যাংকগুলোর আয় কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে ব্যয়। এতে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা কমে যাবে।

ফলে সরকার যেমন ব্যাংকের মুনাফা থেকে রাজস্ব কম পাবে, তেমনি শেয়ারহোল্ডাররা পাবেন কম হারে লভ্যাংশ। একই সঙ্গে ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ তহবিল বাড়ানোর প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনায় যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে, তার সঙ্গে ব্যাংকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্যের জোগান, খেলাপি ঋণ, প্রভিশন রাখা, বিধিবদ্ধ আমানতে বড় ছাড় দেওয়ায় ব্যাংকগুলো এখনো বড় সংকটে পড়েনি। তবে করোনার প্রকোপ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তবে ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নীতি সহায়তার হার বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ঋণ আদায়ের জন্য ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে এবং সরকারকে সহায়তা করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হতে শুরু করবে। তখন ব্যাংকগুলোও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলো নিজেদের মূলধন ও সঞ্চয়কারীদের আমানত ঋণ হিসাবে বিনিয়োগ করে আয় করে। আয়ের ৯০ শতাংশই আসে ঋণের সুদ থেকে। বাকি ১০ শতাংশ আসে কমিশন, বৈদেশিক মুদ্রা ও অন্যান্য খাত থেকে।

গত বছর করোনার কারণে ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে কোনো সুদ আদায় করতে পারেনি বললেই চলে। অথচ এ খাত থেকে সুদ আদায় দেখানো হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই কাগজে-কলমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী নিয়মিত ঋণের সুদ আদায় না হলেও ব্যাংক আয় খাতে নিতে পারে।

কিন্তু খেলাপি হয়ে গেলে সে ঋণের সুদ আদায় না হলে আয় খাতে নিতে পারে না। করোনার কারণে গত বছরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে খেলাপি করতে দেওয়া হয়নি। ফলে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। এতে ওইসব ঋণের সুদ তারা আয় খাতে নিতে পারছে।

কিন্তু এগুলো নগদ আদায় হয়নি। এখন পর্যন্ত আয়ের যে হিসাব তা কাগুজে। কিন্তু ব্যয়ের হিসাব প্রকৃতই। কাগুজে আয় বাড়িয়ে প্রকৃত ব্যয় মিটিয়ে হিসাব মেলানোতেই ব্যাংকগুলোর এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

দেশে বর্তমানে মোট ৬০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬টি, সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংক ৩টি, বেসরকারি ব্যাংক ৪২টি এবং বিদেশি ব্যাংক ৯টি।

মোট ব্যাংকিংয়ের সাড়ে ৬৭ শতাংশই করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ২৮ শতাংশ করে সরকারি ব্যাংকগুলো। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ করে বিদেশি ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে মূলধন থেকে ব্যাংকগুলোর আয়ের অনুপাত ছিল ১০ দশমকি ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার পুঁজি খাটিয়ে ১০ টাকা ৬০ পয়সা আয় করত। ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯০ পয়সায়। খেলাপি ঋণ নবায়নে বড় ছাড় দেওয়ায় ওই বছর আয় কমেছিল।

২০১৯ সালে তা আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ টাকা ৮ পয়সা। ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় তা কমে দাঁড়ায় ৬ টাকা ২০ পয়সায়। নিট হিসাবে তা আরও কমতে পারে বলে ধারণা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর মধ্যে মূলধন থেকে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর আয় বরাবরই নেতিবাচক। কারণ এদের মূলধন ঘাটতি থাকায় মূলধন থেকে আয় সব সময়ই নেতিবাচক থাকে। ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলোর ১০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে আয় লোকসান মুনাফা করেছিল সাড়ে ৩ টাকা।

২০১৮ সালে ১০০ টাকার বিপরীতে লোকসান হয়েছে ২৯ টাকা ৬০ পয়সা। ২০১৯ সালে লোকসান হয়েছে ১৩ টাকা ৭০ পয়সা। ২০২০ সালে ১০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে লোকসান দিয়েছে ১৫ টাকা ২০ পয়সা।

বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেশি হওয়ায় তারাও মূলধন থেকে আয়ের মুখ দেখতে পারে না। ২০১৭ সালে ১০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে লোকসান দিয়েছে ৩ টাকা। ২০১৮ সালে ১০০ টাকায় লোকসান দিয়েছে সাড়ে ১৩ টাকা, ২০১৯ সালে ১৭ টাকা এবং ২০২০ সালে ২৬ টাকা।

ক্রমাগত লোকসানে এ খাতের ব্যাংকগুলোর মূলধন গায়েব হয়ে গেছে। এখন সরকার থেকে পুঁজির জোগান দিয়ে কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একটি সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো অনেক সেবা বিনামূল্যে বা কম মূল্যে দিচ্ছে। সরকারি এলসি খোলার ক্ষেত্রে যথাযথ কমিশন দেওয়া হয় না। অথচ বেসরকারি ব্যাংককে ঠিকই দেওয়া হয়। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন সেবা দিতে গিয়ে ব্যাংকের লোকসান হচ্ছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও মূলধন থেকে আয় কমে গেছে। ২০১৭ সালে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে আয় করেছে ১২ টাকা। ২০১৮ সালে তা কমে আয় হয়েছে ১১ টাকা। ২০১৯ সালে আয় কিছুটা বেড়ে হয়েছে ১১ টাকা ২০ পয়সা। ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ টাকায়।

বিদেশি ব্যাংকগুলোর আয় সামান্য বেড়েছে। ২০১৯ সালে তারা ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে আয় করেছিল ১৩ টাকা ৪০ পয়সা। গত বছর তা হয়েছে ১৩ টাকা ৫০ পয়সা।

এদিকে ব্যাংকগুলোর প্রধান সম্পদ হচ্ছে ঋণ। ঋণের বিপরীতে গত বছর সুদ আদায় করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে সুদ থেকে আয় কমে গেছে। ২০১৭ সালে ১০০ টাকার সম্পদ বা ঋণ থেকে সুদ আয় হয়েছে ৭০ পয়সা।

২০১৮ সালে তা কমে ৩০ পয়সা, ২০১৯ সালে ৪০ পয়সা এবং ২০২০ সালে আবার কমে ৩০ পয়সা আয় হয়েছে। এ আয়ের বেশির ভাগই কাগুজে। বাস্তবে সুদ আদায় হয়নি।

সুদ মওকুফ, সরকারি নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর সুদ আয় প্রায় বছরই থাকে নেতিবাচক। সরকারি ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে সুদ আয়ে ১০০ টাকায় লোকসান হয়েছে ৬০ পয়সা। গত বছরের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে তা আরও বাড়তে পারে।

বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে লোকসান ছিল ৩ টাকা ৩০ পয়সা। গত বছর লোকসান হয়েছে ৫ টাকা ৩০ পয়সা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে আয় হয়েছিল ১০০ টাকায় ৮০ পয়সা। ২০২০ সালে আয় হয়েছে ৫০ পয়সা।

সুদ আদায় করতে না পারায় বিদেশি ব্যাংকগুলোরও এ খাতে আয় কমেছে। ২০১৯ সালে ১০০ টাকায় আয় হয়েছিল ২ টাকা ৩০ পয়সা। গত বছর আয় হয়েছে ২ টাকা ২০ পয়সা।

আয় কমলেও ব্যাংকগুলোর খচর বেড়ে গেছে। বিশেষ করে করোনার কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যাংক খোলা রাখা, ব্যাংকারদের প্রণোদনা প্রদানসহ নানা কারণে খরচ বেড়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে খরচ করেছে ৭৬ টাকা ৬০ পয়সা। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৭৮ টাকা হয়েছে। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ১০ পয়সা।

এর মধ্যে সরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে খরচ হয়েছে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছে ১৫৯ টাকা ৮০ পয়সা। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে খরচ করেছে ১৮৯ টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো ২০১৮ সালে ১০০ টাকা আয় করে ৭৬ টাকা ৭০ পয়সা খরচ করেছে। ২০১৯ সালে তা আরও বেড়ে ৭৭ টাকা ৬০ পয়সা খরচ করেছে। ২০২০ সালে খরচের পরিমাণ আরও বেড়ে ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে খরচ করেছে ৮২ টাকা ৬০ পয়সা।

আলোচ্য সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খরচ কমেছে। ২০১৯ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছে ৪৮ টাকা ৮০ পয়সা। ২০২০ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছে ৪৫ টাকা ৫০ পয়সা।

সূত্র জানায়, করোনার ধাক্কায় গত এক বছর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার কমেছে। এছাড়া মার্কিন ডলার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরো, যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ডসহ প্রধান সব দেশের মুদ্রার দাম কমেছে। ফলে এসব খাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ থেকেও আয় কমেছে।

করোনায় মানুষের বিদেশ ভ্রমণ, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে বা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া কমেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি ও কমিশন থেকেও কমেছে আয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক নয়
ফুটবল খেলায় অংশ নেওয়া ব্যাংকারদের ‘বিশেষ বোনাস’ দেয়ার আহ্বান এবিবির
ব্যাংকের চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তারা অবসরকালীন সুবিধা পাবেন না