বিদেশ থেকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়লেও সে তুলনায় টাকা তোলা কম হয়েছে। একই চিত্র করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও। চলতি বছরের মার্চে ক্ষতি কিছুটা কম হলেও এপ্রিলে পুরোপুরি থেমে গেছে। সব মিলিয়ে একের পর এক করোনার অভিঘাতে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকাংশে স্থবির হয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগ না হওয়ায় চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। তবে ঈদকে ঘিরে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে ব্যাংকিং খাত-এমন ধারণা ব্যাংকারদের।
জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল হালিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সাময়িক স্থবির হলেও ঈদকে ঘিরে অর্থের ব্যাপক চলাচল হবে। অর্থাৎ মে মাসে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমতে পারে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ মুহূর্তে তারল্য এবং ডলারের কোনো ঘাটতি নেই। ব্যাংকগুলোর হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। তবে আসছে রোজার ঈদে তারল্য কিছুটা কমতে পারে। কারণ সবকিছু খুলে দিচ্ছে, লেনদেন হবে অনেক।
সূত্র জানায়, ঋণের চাহিদা বাড়ার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তারল্য কমছিল। যা ফেব্র“য়ারিতে এসে আরও কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, ফেব্র“য়ারি শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকা, এক মাস আগে যা ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭০ কোটি টাকা। তবে গত এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে ৯২ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত বছরের ফেব্র“য়ারিতে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যেও পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যে ফেব্র“য়ারিতে কমলেও মার্চ এবং এপ্রিল মাসে বাড়বে। কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশের অর্থনীতিতে আবারও বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। তারা বলছেন, জানুয়ারি ও ফেব্র“য়ারিতে ঋণের চাহিদা কিছুটা বাড়লেও বর্তমানে এই চাহিদা আবার কমতে শুরু করেছে।
এদিকে করোনাভাইরাসে ব্যবসায়ীরা গুটিয়ে গেলেও কম সুদের প্রণোদনা ঋণে যেন আবার প্রাণ ফিরে পান। পুরোনো ঋণ পরিশোধেই হোক বা চলতি মূলধনের জন্যই হোক, ব্যবসায়ীরা সীমিত পরিসরে ঋণ নিয়েছেন। ফলে ২০২০ সালে ঋণ বিতরণ ভালো হয়েছে।
এরপরও ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা বর্তমানে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিলবন্ডে বিনিয়োগ করেছে। বাকি টাকা ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে। ব্যাংকগুলোর জুলাই-ফেব্র“য়ারি সময়ের তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ‘লকডাউনে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক বিভাগ বন্ধ থাকায় মার্চের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। আর এপ্রিলে উদ্বৃত্ত তারল্য সবচেয়ে বেশি হবে। কারণ মাসের পুরোটা কেটেছে লকডাউনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ বেড়ে গত জানুয়ারিতে ১২ লাখ ৮৬ হাজার ২০১ কোটি টাকায় উঠেছে। এত বিপুল আমানত আগে কখনো দেখা যায়নি। ২০২০ সালের জুন শেষে আমানত ছিল ১১ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ২০২ কোটি টাকা। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। তারও আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছিল ৪০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এতে দেখা যায়, করোনার মধ্যেই আমানত বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, করোনার মধ্যে প্রবাসী আয় অনেক বেশি এসেছে। এসব টাকার বড় অংশ ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হয়েছে। আগে যারা সঞ্চয় করেননি, তারাও করোনাকালে সঞ্চয় করতে শুরু করেছেন। আসলে করোনা সবাইকে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়ার কারণেই সঞ্চয়ের প্রবণতা ও পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে সোনালীর। গত ডিসেম্বর শেষে এই ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। সোনালীর পেছনে রয়েছে অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক। বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। জানুয়ারি শেষে ব্যাংকটিতে আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের জুনে ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকটিতে আমানত ছিল ৯৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।পূবালী ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ৪৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এরপরই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৪৩ হাজার ১৫৮ কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংকে ৪২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার আমানত রয়েছে।
এদিকে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকগুলো মোট ৯৫ হাজার ৭২৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে সার্বিক ঋণের পরিমাণ গত জানুয়ারিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৪৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের জুন শেষে ছিল ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা (এই ঋণ নন-ফান্ডেড দায়সহ, গত জানুয়ারিতে শুধু ঋণ ছিল ১১ লাখ ২১ হাজার ১২২ কোটি টাকা)। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৯৬ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। তার আগের ২০১৮-১৯ সালের একই সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৬৭ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করতে সরকার কম সুদের এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করে। ওই প্যাকেজের ঋণ বিতরণ এখনো চলছে। ইতোমধ্যে ৭৫ হাজার কোটি টাকার মতো বিতরণ হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজের ফলে জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ঋণ বিতরণ আগের বছরের একই সময়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।