উল্টো পথে চলে গেছে ১১ ব্যাংকের ঋণের সুদহার। এর মধ্যে সাত ব্যাংকের ঋণের চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি উঠে গেছে। আর প্রান্তিক অবস্থানে নেমে গেছে আরো চার ব্যাংকের ঋণের সুদহার। ঋণ আমানতের সুদহারের এ পার্থক্য (সুদহারের ব্যাপ্তি) ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে ৬০টি ব্যাংক ও ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। এ কারণে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। একে তো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ব্যাংক লেনদেন কমে গেছে, এর ওপর সুদহারের প্রভাব; সবমিলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার উপক্রম হয়েছে।
ঋণ আমানতের সুদহারের ব্যবধানে এ অস্বাভাবিক পতনের ব্যাপারে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অর্থনীতির আকার অনুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। এ কারণে আমানত সংগ্রহে একধরনের অশুভ প্রতিযোগিতা আছে। একই আমানত নিয়ে একাধিক ব্যাংক কাড়াকাড়ি করছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী রাতারাতি ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাধ্য হলেও আমানতের সুদহার ওই হারে কমানো যায়নি। আর এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও আমানতের সুদহার অভিন্ন করার ওপরে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। শুধু ঋণের সুদহারের বিষয়ে ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ কারণে তহবিল সঙ্কটে রয়েছে এমন কিছু ব্যাংক আমানত হারানোর ভয়ে রাতারাতি আমানতের সুদহার কমাতে পারেনি। এর ফলেই ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার উপক্রম হয়েছে।
ঋণ আমানতের সুদহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ আমানতের সুদহারের গড় ব্যবধান ৩ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে গেছে। এ সময়ে আমানতের গড় সুদহার কমে নেমেছে ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশে, বিপরীতে ঋণের গড় সুদহার নেমেছে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে। তবে বিদেশী ৯ ব্যাংকের সুদহার বাদ দিলে প্রকৃতপক্ষে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গড় সুদহারের ব্যবধান আরো কমে যাবে। কারণ বিদেশী ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। কিন্তু ঋণের গড় সুদহার পৌনে ৭ শতাংশ। এর মধ্যে বেশির ভাগ বিদেশী ব্যাংকেরই ঋণ আমানতের সুদহারের ব্যবধান ৫ শতাংশের উপরে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাত ব্যাংকের আমানতের চেয়ে ঋণের সুদহার কমে গেছে। আর চারটি ব্যাংকের সুদের ব্যাপ্তি প্রান্তিক অবস্থান অর্থাৎ এক শতাংশে নেমে গেছে।
আমানতের চেয়ে ঋণের সুদহার বেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ফেব্রুয়ারি মাসে আমানতের গড় সুদহার ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ, যেখানে ঋণের গড় সুদহার ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এতে মাস শেষে সুদের ব্যাপ্তি হয়েছে ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংকের (বিডিবিএল) আমানতের গড় সুদহার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যেখানে ঋণের গড় সুদহার ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ আলোচ্য মাসে সুদের ব্যাপ্তি ছিল শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। এ দিকে বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের মধ্যে তিন ব্যাংকেরই আমানতের চেয়ে ঋণের সুদহার প্রান্তিক অবস্থানে নেমে গেছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের সুদের ব্যাপ্তি নেমেছে শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সুদের ব্যাপ্তি নেমেছে ঋণাত্মক ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। নতুন প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার যেখানে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, সেখানে ঋণের গড় সুদহার ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকটির সুদের ব্যাপ্তি নেমে হয়েছে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার ব্যাপ্তি হয়েছে ঋণাত্মক শূন্য ৮ শতাংশ। অপর দিকে নতুন প্রজন্মের গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার ব্যাপ্তি ১ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং মেঘনা ব্যাংকের ১ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনার প্রভাবে ব্যবসাবাণিজ্যের মন্দায় ব্যাংক লেনদেন কমে গেছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি ব্যয় কমে নেমেছে ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ঋণাত্মক ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর সাথে রয়েছে ঋণের সুদহার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গত বছর ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু ওই সময় রাতারাতি আমানতের সুদহার কমানো যায়নি। আবার কিছু কিছু ব্যাংকের তহবিল সঙ্কট রয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমাতে পারছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর আয়ের ওপর। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, তহবিল সঙ্কট মেটাতে কিছু কিছু ব্যাংক আমানত আকৃষ্ট করতে এখনো বেশি হারে সুদ দিচ্ছে। এতেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটা কাটানোর জন্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঋণ আমানতে উভয়ের ক্ষেত্রেই বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে হবে, না হয় ঋণের মতো আমানতেরও সুদহার বেঁধে দিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের অসম প্রতিযোগিতা কাটবে না বলে তারা মনে করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে ব্যাংকাররা মনে করেন।