অস্থায়ী সম্পত্তি জামানত রেখে ব্যাংকঋণ দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করছে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এই বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ‘জামানত সুরক্ষা (অস্থাবর সম্পত্তি) আইন’ এর মাধ্যমে অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আইনে অস্থাবর সম্পত্তির যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে তা আরো স্পষ্টীকরণ করার প্রয়োজন রয়েছে।
তাই আইনের উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রস্তাবিত ‘জামানত সুরক্ষা (অস্থাবর সম্পত্তি) আইন’টি ভাষাগত দিক থেকে আরো সহজ ও বোধগম্য করে এর একটি পরিমার্জিত খসড়া প্রণয়ন এবং আইনে ‘অস্থাবর সম্পত্তি’র সংজ্ঞা সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। একই সাথে অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে ব্যবহারের শর্তাবলি নির্ধারণ, জামানত হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিবন্ধন করা, নিবন্ধন সম্পন্ন ও বাতিলের জন্য কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ এবং প্রণীত খসড়া আইনটি অন্যান্য আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনাপূর্বক অবহিত করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক গঠিত ‘জামানত সুরক্ষা (অস্থাবর সম্পত্তি) আইন ২০২০-এর খসড়ার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত প্রদান সংক্রান্ত কমিটির প্রথম বৈঠকে এসব মতামত ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, স্বর্ণ-শেয়ারসহ স্থানান্তরযোগ্য বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ব্যাংকঋণ প্রদানে ‘জামানত সুরক্ষা (অস্থাবর সম্পত্তি) আইন’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি গত মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত প্রদান সংক্রান্ত কমিটি’তে পাঠানো হয়। এই কমিটির প্রথম বৈঠকটি চলতি মাসের ৮ তারিখের অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, বৈঠকে খসড়া আইনের ওপর মতামত প্রদানকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব শফিউল আজিম বলেন, খসড়া আইনের ভাষা অত্যন্ত দুর্বোধ্য। ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করায় ভাষাগত দুর্বলতা রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের সাথে একাধিক আইনের সংশ্লিষ্টতা থাকায় সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর বিষয়বস্তু প্রস্তাবিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কি নাÑ তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। একই সাথে সাধারণ মানুষের কাছে ঋণ সহজলভ্য করার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আইন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কি না এবং অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত প্রদান সংক্রান্ত কমিটির প্রথম বৈঠকে আরো যেসব পরামর্শ বা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলো হচ্ছেÑ অস্থাবর সম্পত্তির নিবন্ধন সম্পন্ন ও বাতিলের পদ্ধতি এবং শর্তাবলি নির্ধারণের এখতিয়ার সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রদান করা। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণের পরিমাণ বা ঋণসীমা নির্ধারণ করা। কোনো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অস্থাবর সম্পত্তি জামানত রেখেও ঋণ না পেলে আইনে এর প্রতিকার সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করা। ঋণখেলাপি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান যুক্ত করা এবং প্রস্তাবিত আইনে যেসব শব্দ বা অভিব্যক্তি একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর সংজ্ঞা প্রদান করা।
প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বর্তমানে দেশে স্থাবর সম্পত্তি যেমন- জমি, বাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জামানত হিসেবে বন্ধক রেখে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ প্রাপ্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু স্থানান্তরযোগ্য বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ প্রাপ্তির কোনো বিধান না থাকায় বৈধভাবে ঋণ গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। এ প্রেক্ষিতে প্রচলিত ঋণ/বিনিয়োগ ব্যবস্থায় স্থানাস্তরযোগ্য/অস্থাবর সম্পদকে জামানত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অধিক মানুষের কাছে ঋণ/বিনিয়োগ সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হচ্ছে।
ব্যাংক খাতের সূত্রগুলোর মতে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের আইন বাস্তবায়ন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ আইনটি কতটা ইতিবাচক হবে এটা নির্ভর করছে আইনটির স্বচ্ছতা ও পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর কার্যকর প্রয়োগের ওপর। প্রণীতব্য আইনে যদি কোনো দুর্বলতা বা ফাঁকফোকর থাকে এতে প্রতারণা বেড়ে যেতে পারে এবং ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান প্রতারিত হবে। এসবে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রণীত খসড়ায় আইনটি বাস্তবায়নে একটি ‘সিকিউরড ট্রানজ্যাকশন রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশোধিত খসড়ায় জামানতযোগ্য অস্থাবর সম্পত্তি নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে এক বছর মেয়াদে ঋণ প্রদান, ঋণ খেলাপি হওয়া ও স্বেচ্ছা ঋণখেলাপির বিষয়ে প্রস্তাবিত আইনে বিধি-বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
এ দিকে প্রস্তাবিত খসড়া আইনে জামানত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে এমন দশ ক্যাটাগরির অস্থাবর সম্পত্তি চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দ্বারা সমর্থিত ও সুরক্ষিত রফতানির উদ্দেশ্যে বা রফতানি আদেশ অনুযায়ী পণ্য তৈরির কাঁচামাল। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত আমানতের সনদ। স্বর্ণ-রৌপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু যার ওজন ও বিশুদ্ধতার মান স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ দ্বারা সার্টিফায়েড। নিবন্ধিত মানসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার সার্টিফিকেট। মেধাস্বত্ব অধিকার দ্বারা স্বীকৃত মেধাস্বত্ব পণ্য (প্যাটেন্ট কপিরাইট)। কোনো সেবার প্রতিশ্রুতি যার বিপরীতে সেবাগ্রহীতার মূল্য পরিশোধের স্বীকৃত প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে (ওয়ার্ক অর্ডার)। আসবাব-কাষ্ঠল উদ্ভিদ-ফলদ উদ্ভিদ-ওষুধি উদ্ভিদ-ইলেকট্রনিক পণ্য, সফটওয়্যার, অ্যাপস যার মূল্য প্রাক্কলন করা সম্ভব; যান্ত্রিক বা অযান্ত্রিক যানবাহন। খনিজসম্পদ (তেল, গ্যাস, হাইড্রোকার্বন ও ভূ-গর্ভস্থ মূল্যবান ধাতু) এবং যথাযথভাবে সংরক্ষিত কৃষিজাত পণ্য-প্রক্রিয়াজাত মৎস্য বা জলজ প্রাণিসম্পদ-আয় উৎসারী জীবজন্তু (অজাত শাবকসহ)।
আইনটি প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জামানত আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে বলেছেন, বর্তমানে দেশে স্থাবর সম্পত্তি যেমন- জমি, বাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জামানত হিসেবে বন্ধক রেখে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়া যায়। কিন্তু স্থানান্তরযোগ্য বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ প্রাপ্তির কোনো বিধান না থাকায় বৈধভাবে ঋণ গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। এ প্রেক্ষিতে প্রচলিত ঋণ/বিনিয়োগ ব্যবস্থায় স্থানাস্তরযোগ্য/অস্থাবর সম্পদকে জামানত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অধিক মানুষের কাছে ঋণ/বিনিয়োগ সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হচ্ছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ এক বছর অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়া যাবে। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতার পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এই মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে।