ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মাধ্যমে ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে আসছে আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ। এই প্যাকেজের আকার হবে ১০ হাজার কোটি টাকা। কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) ৪ শতাংশ সুদে চলতি মূলধন দিতে নেওয়া হয়েছে নতুন এই প্যাকেজ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ব্যাপারে যে নীতিমালা তৈরি করেছে, তা গত সোমবার অনুমোদন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদিত নীতিমালা অনুযায়ী নতুন প্যাকেজের আওতায় দেওয়া ঋণের সুদহার হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এনজিওগুলো গ্রাহকদের ঋণ দেবে বার্ষিক ৪ শতাংশ সুদে। বাকি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে। এর মধ্যে এনজিওগুলো পাবে ৪ শতাংশ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে ১ শতাংশ আর বাংলাদেশ ব্যাংক পাবে দশমিক ৫ শতাংশ।
এ সম্পর্কে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের বক্তব্য নিতে গতকাল তাঁর কার্যালয়ে গেলেও দেখা পাওয়া যায়নি। তবে গত মাসে ‘করোনাকালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে সচিব বলেছিলেন, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এমএফআইগুলোর যোগাযোগটা ব্যাংকের চেয়ে ভালো। এ কারণেই ঋণ বিতরণে এমএফআইগুলোকে বেছে নেওয়া।
সচিব ওই সেমিনারে আরও বলেন, ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল, তার বিতরণ ভালো ছিল না। অনেক চাপ প্রয়োগ করা হলেও ব্যাংকগুলো অনীহ ছিল।
কেন নতুন প্যাকেজ
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত ডিসেম্বরেই খসড়া আকারে ‘নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাব মোকাবিলায় সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের দ্রুত ঋণ দেওয়ার সহায়ক নীতিমালা’ তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, কোভিড-১৯–এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণ এই প্যাকেজ তৈরির উদ্দেশ্য।
আরও বলা হয়, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিসিকসহ বিভিন্ন সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া উদ্যোক্তারাও এই প্যাকেজের ঋণ পাবেন। বিদেশ থেকে দেশে ফেরা এবং শহর থেকে গ্রামে ফেরা নতুন উদ্যোক্তাদেরও দেওয়া হবে ঋণ।
অনুমোদিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, ১০ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন (ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি) করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (এমআরএ), তফসিলি ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এমএফআই। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদার ভিত্তিতে তাদের সুদ–ভর্তুকির অর্থ দেবে অর্থ বিভাগ।
কে কত টাকা পাবে
একক বা গ্রুপ—যেভাবেই হোক না কেন, এই প্যাকেজের আওতায় কোনো গ্রাহক ৫০ লাখ টাকার বেশি ঋণ পাবেন না। এর মধ্যে কুটিরশিল্প পাবে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ। এ ছাড়া অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সর্বোচ্চ ৩০ লাখ ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবে। তবে এই ঋণের টাকায় কোনো গ্রাহক তাঁর আগে নেওয়া কোনো ঋণ সমন্বয় বা পরিশোধ করতে পারবেন না।
গ্রাহক পর্যায়ে প্যাকেজের ৪০ শতাংশ ট্রেডিং খাতে এবং ৬০ শতাংশ উৎপাদন ও সেবা খাতে বিতরণ করতে হবে। ঋণগ্রহীতা ছয় মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৮টি কিস্তিতে অর্থ পরিশোধের সুযোগ পাবেন। ঋণের মোট মেয়াদ দুই বছর।
কারা দেবে ঋণ
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা নেবে এমআরএর সনদ পাওয়া এনজিওগুলো। তবে শুরুতেই এমআরএ থেকে তাদের ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাবিষয়ক প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। এরপর এনজিওগুলোর আবেদনের এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা ছাড় করবে। এনজিওগুলো গ্রাহকদের তা দেবে দ্রুততম সময়ে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এনজিওগুলো যে ঋণ নেবে, তার বিপরীতে ঋণ পরিশোধের ঘোষণাপত্র এবং ঋণস্থিতি জামানত হিসেবে রাখতে হবে। গ্রাহকদের দেওয়ার জন্য একটি এনজিও সর্বোচ্চ ৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারবে।
গ্রাহকদের কী কী লাগবে
নির্বাচিত গ্রাহকদের ঋণ আবেদনের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অথবা জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্টের কপি কিংবা ট্রেড লাইসেন্স অথবা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার কাউন্সিলরের অথবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অথবা স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নপত্র লাগবে। পাশাপাশি অন্য দুজনের নিশ্চয়তাপত্রও (গ্যারান্টি) লাগবে। অন্য দুজন কারা হবেন, পরিবারের সদস্য কেউ হবেন, নাকি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা আত্মীয়স্বজন—এ ব্যাপারে অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি অনুমোদিত নীতিমালায়।
এবারও বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা
প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ব্যাংকাররা এই প্যাকেজ বাস্তবায়নেও অনীহ বলে জানা গেছে। একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনজিওগুলোকে ঋণ দেওয়ায় ঝুঁকি কম নয়। আবার পাওয়া যাবে মাত্র ১ শতাংশ সুদ। সুদের হার ২ থেকে ৩ শতাংশ করলে বরং প্যাকেজটি কার্যকর হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকার যেহেতু একটি উদ্যোগ নিয়েছে, সব ব্যাংকেরই উচিত হবে এটাকে সফল করা। ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য প্যাকেজটির বাস্তবায়ন জরুরি। এ নিয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।