ঢাকা বুধবার, ডিসেম্বর ৪, ২০২৪
গভর্নরের সঙ্গে ব্যাংক এমডিদের বৈঠকঃ ঋণের কিস্তি পরিশোধে শিথিলতা থাকছেনা
  • ব্যাংকবীমাবিডি
  • ২০২১-০১-২৭ ২১:১৪:১৬

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের চলমান প্রভাব মোকাবিলা করে ব্যাংক খাতকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে এখন থেকে খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করার জন্য ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

একই সঙ্গে তিনি ব্যাংকগুলোর নিয়মিত ঋণের কিস্তির মেয়াদ শেষ হলে তা আদায় করার নির্দেশ দেন। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম থেকে যেসব ঋণের বা কিস্তির মেয়াদ শেষ হবে, সেগুলো এখন থেকে আদায় করতে হবে।

বুধবার (২৭ জানুয়ারী) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডিদের সঙ্গে অনলাইনে অনুষ্ঠিত একসভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এসব নির্দেশনা দেন। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা অংশ নেন। নতুন বছর শুরু হওয়ার পর এটিই প্রথম ব্যাংকার্স সভা।

ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় ছিল বিদায়ী বছরজুড়ে। সরকারের নির্দেশনা এবং ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২০ সালে কোনো কিস্তি পরিশোধ না করেই খেলাপি হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন ঋণগ্রহীতারা। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে সময়সীমা না বাড়ানোর পক্ষেই মত দিয়েছেন দেশের সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। একই অভিমত জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও। সে হিসেবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ গণনা শুরু হলো।

গতকালের বৈঠকে গভর্নর ফজলে কবির ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাংক এমডিদের মতামত জানতে চান। তখন ব্যাংক এমডিরা বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের কথা চিন্তা করে বছরব্যাপীই ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়া হয়েছে। এখন নতুন করে মেয়াদ বাড়ানো ঠিক হবে না। ব্যাংকের অর্থ ব্যাংকে ফেরার সময় এসেছে।’ ব্যাংক নির্বাহীদের এ দাবির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঐকমত্য পোষণ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।

করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে বিদায়ী বছরের এপ্রিলে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। সরকারের নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণীমানে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। এরপর এ ছাড়ের মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরে তৃতীয় দফায় প্রজ্ঞাপন জারি করে এ সুযোগ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ডিসেম্বর শেষ হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়ে গভর্নরকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। ব্যাংক চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ একই দাবি জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সময়সীমা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়েছিল। তখন পর্ষদ থেকে এ বিষয়ে নেতিবাচক মতামত দেয়া হয়। গতকাল ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাও একই মতামত দেয়ায় ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা না বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্ষদের অভিমতও প্রায় একই। এজন্য নতুন করে এ সময়সীমা বাড়ানো হবে না।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে ঋণ পরিশোধে শিথিলতা দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে তখন আমরা সবাই স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু এ ধরনের সুবিধা দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। এজন্য এবিবির পক্ষ থেকে আমরা ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ না বাড়ানোর অনুরোধ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের মতামতের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। মেয়াদ আবারো বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হতো। এখন ব্যাংকের অর্থ ব্যাংকে ফেরার সময় হয়েছে।

ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকার্স সভা’ আয়োজন করা হয়। মহামারীর কারণে গতকালের বৈঠকটি হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে। বেলা ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এএন হামিদুল্লাহ সম্মেলন কক্ষ থেকে গভর্নর ফজলে কবিরসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা বৈঠকে যোগ দেন। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংক নির্বাহীরা অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।

বৈঠকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রানীতি, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অগ্রগতি, ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থতাসহ ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠকে উপস্থাপন করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করতে ২১টি আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এতে মোট অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।

এর মধ্যে ৯টি প্যাকেজ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এগুলো হলো-বড় শিল্প ও সেবা খাতে ৩৩ হাজার টাকা, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৭ হাজার কোটি টাকা, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এপ্রিল ও মে মাসের সুদ ভর্তুকি বাবদ ২ হাজার কোটি টাকা, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি খাতে প্রিশিপমেন্ট ক্রেডিট ৫ হাজার কোটি টাকা, নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, ক্ষুদ্র কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং এসএমই খাতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ২ হাজার কোটি টাকা।

বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয় যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ চলমান থাকবে, সেগুলো থেকে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে। ঋণ বিতরণে কোনো ধরনের শৈথিল্য যাতে না করা হয়, সেদিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর নির্বাহীরা বলেন, প্রণোদনার শর্ত বাস্তবায়ন করলে ঋণ বিতরণে কোনো দেরি করা হচ্ছে না। তবে অতি ক্ষুদ্র শিল্পগুলো ঋণের শর্ত পালন করতে পারছে না। এছাড়া তারা ব্যাংকে আসতেও আগ্রহী নয়। এ কারণে এ খাতে ঋণ বিতরণ কম। এরপরও শাখাগুলোর মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে ঋণ নিতে।

বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমদানি বাবদ স্থানীয় ও বৈদেশিক যেসব এলসি খোলা হচ্ছে, সেগুলোর বিল নিয়মিত পরিশোধ করা হচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও অভিযোগ আসছে। এতে বিশেষ করে বৈদেশিক দেনা শোধ না করায় বিদেশে বাংলাদেশের দুর্নাম হচ্ছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের এমডিদের বকেয়া আমদানির বিল দ্রুত পরিশোধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোনো ব্যাংক যৌক্তিক কারণ ছাড়া আমদানির বকেয়া বিল পরিশোধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাব থেকে টাকা কেটে বিল পরিশোধ করা হবে।

এ বিষয়ে ব্যাংকের এমডিদের পক্ষ থেকে বলা হয়, কিছু নিয়ে ব্যাংকগুলোর তীব্র আপত্তি আছে-এ কারণে এগুলো পরিশোধ করতে দেরি হচ্ছে। তারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার কথা বলেন।

ব্যাংক খাত সংস্কারে ৬ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন
আদায়কৃত অতিরিক্ত সুপারভিশন চার্জ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ
স্বতন্ত্র পরিচালকের যোগ্যতা-বেতন কত জানালো কেন্দ্রীয় ব্যাংক