বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান সংবাদপত্র গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন বিশ্বের তিনটি শীর্ষস্থানীয় রেটিং এজেন্সি মুডি’স, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স এবং ফিচের দীর্ঘমেয়াদি ক্রেডিট রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক নিরাপদ ব্যাংকের তালিকা প্রস্তুত করে থাকে এবং গত বছর ১৯ অক্টোবর ২৯ তম বার্ষিক র্যাঙ্কিং ঘোষণা করে। ম্যাগাজিনটির প্রকাশক ও সম্পাদক বলেন,এ ব্যাংকগুলো সরকারি মালিকানায় নেই এবং বিশ্বের শক্তিশালী ও নিরাপদ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি আরো জানান, বিশ্বজুড়ে কিছু বাজারে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত আস্থাপূর্ণ ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন করা। র্যাংকিংয়ে বিশ্বের শীর্ষ ২৫টি নিরাপদ ব্যাংকের মধ্যে ১০টি ইউরোপীয়, জার্মানীর KfW Development Bank দীর্ঘ ১২ বছর যাবৎ শীর্ষ স্থান দখল করে আছে। শীর্ষ ২৫ এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে ৩টি ব্যাংক যথাক্রমে ডিবিএস ব্যাংক, ওসিবিসি এবং ইউনাইটেড ব্যাংক এবং কোরিয়ার কোরিয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইমপোর্ট এক্সপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া এবং ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ব্যাংক অব কোরিয়া।
২০১৯ সালে শীর্ষ ১০টি নিরাপদ ব্যাংকের তালিকাঃ
র্যাংকিং |
নাম |
দেশ |
ফিচ |
মুডি’স |
এস এন্ড পি |
মোট স্কোর |
সম্পদ (মিলিয়ন মাঃডঃ |
১ |
KfW Development Bank |
জার্মানী |
AAA |
Aaa |
AAA |
৩০ |
৫৫৬,৪২৪ |
২ |
Zuercher Kantonalbank |
সুজারলেন্ড |
AAA |
Aaa |
AAA |
৩০ |
১৭২,৬৭১ |
৩ |
BNG Bank |
নেদারল্যান্ডস |
AAA |
Aaa |
AAA |
৩০ |
১৫৭,৫০৩ |
৪ |
Landwirtschaftliche Rentenbank |
জার্মানী |
AAA |
Aaa |
AAA |
৩০ |
১০৩,১১৩ |
৫ |
Nederlands Waterschapsbank (L-Bank) |
জার্মানী |
AAA |
Aaa |
AAA |
৩০ |
৭৯,৬৯২ |
৬ |
Nederlandse Waterschapsbank |
নেদারল্যান্ডস |
NR |
Aaa |
AAA |
২৯ |
৮৬,৫৭৬ |
৭ |
Kommunalbanken |
নরওয়ে |
NR |
Aaa |
AAA |
২৯ |
৪৮,৫৮৩ |
৮ |
NRW.BANK |
জার্মানী |
AAA |
Aa1 |
AA- |
২৬ |
১৬৯,১৬৫ |
৯ |
Swedish Export Credit Corp. |
সুইডেন |
NR |
Aa1 |
AA+ |
২৬ |
৩১,৬২৩ |
১০ |
Banque et Caisse d’Epargne d e l’ETAT |
ফ্র্যান্স |
NR |
Aa2 |
AA+ |
২৪.৫ |
৫২,৫৬৬ |
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ। খেলাপী ঋণ, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন, প্রভাবশালীদের দাম্ভিকতা, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নতজানু নীতি ইত্যাদির কারণে ব্যাংক খাত ডুবতে বসেছে।
দেশে ২০০৯ সালের শুরু থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে বছরে গড়ে ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। এ সময়কালে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণ খেলাপিদের অনুকূলে বারবার আইন সংশোধন ও নীতি প্রণয়ন ব্যাংকিং খাতকে ঋণ খেলাপিবান্ধব করেছে এবং খেলাপি ঋণকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে যা নিয়মিত ঋণ গ্রহীতাকেও খেলাপি হতে উৎসাহিত করছে।
সংস্থাটির মতে, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বিপুল পরিমাণের খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চরম মূলধন সংকট তৈরি করেছে। আর এ সংকট কাটাতে প্রতিবছর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে জনগণের করের টাকা থেকে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।
ঋণ খেলাপি হওয়া এবং তা আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দূর্বল তদারকি ব্যবস্থার সমালোচনা করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে।
সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ:
১. ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে।
২. ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’ এর ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে।
৩. বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে; যেখানে নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে।
৪. বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিন জন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির (সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ যেমন আর্থিক খাত ও সুশাসন বিষয়ক) সংখ্যা বাড়াতে হবে।
৫. ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনগুলোতে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে (যেমন, একই পরিবারের পরিচালক সংখ্যা, পরিচালকের মেয়াদ, পর্ষদের মোট সদস্য সংখ্যা হ্রাস করা ইত্যাদি)।
৬. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. আদালতের স্থগিতাদেশ পাওয়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং রাখার বিধান প্রণয়ন করতে হবে।
৮. বারবার পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
৯. ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বাড়াতে হবে; প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে; পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সীমিত হলেও পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে।
১০. তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।