বছরব্যাপী ঋণমাণ অপরিবর্তিত রাখার বিশেষ সুবিধা নিয়েও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি ঋণ বিতরণও বেড়েছে খাতটির। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে (২০২০) নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়ে ১০ হাজার ২৪৪ কোটি ৭০ লাখ টাকায় পৌঁছেছে, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৫ শতাংশ। আগের প্রান্তিকে খেলাপি ছিল মোট ঋণের ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহুদিন থেকেই আস্থাহীনতায় ভুগছে আর্থিক খাত। এর প্রধান কারণ, গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা। পিপলস লিজিং অবসায়নের পর খাতের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। শুধু পিপলস নয়, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে সংকটাপন্ন আর্থিক খাতের অন্তত ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান। এগুলোর অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে মোট ৬৬ হাজার ২১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১০ হাজার ২৪৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৯ সালের একই সময়ে খেলাপির হার ছিল ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। এতে হিসাব করে দেখা গেছে, আগের (২০১৯) বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে খেলাপির হার বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কী মানের, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালের ১৭ জুন বিশেষ সফটওয়্যার চালু করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর মতো এসব প্রতিষ্ঠানকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রথম তালিকার প্রতিষ্ঠানগুলো থাকছে সাধারণ (সবুজ) শ্রেণিতে। এর পরের ধাপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় দুর্বল (হলুদ)। আর তৃতীয় ক্যাটেগরির প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমস্যাগ্রস্ত (লাল) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত সেপ্টেম্বরে প্রথম ক্যাটেগরিতে ৪টি, দ্বিতীয় ধাপে ১৮টি ও তৃতীয় ধাপে ১১টি প্রতিষ্ঠান ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, লাল তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিআইএফসি, এফএএস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং ও প্রাইম ফাইন্যান্স অন্যতম। তবে এই খাতে সবই খারাপ নয়। আইডিএলসি, আইপিডিসি, আইআইডিএফসি, ইসলামিক ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের মতো বেশ কিছু ভালো প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছুটা বেড়েছে। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে পুরো আর্থিক খাতে। পিপলস দুর্ঘটনার পর দুর্বলগুলোয় জনগণ টাকা না রাখলেও ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোয় টাকা রাখছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিশেষ সুবিধার পর খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও করোনার আঘাতে পুরো অর্থনৈতিক চাপ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এ মুহূর্তে পরিচালনা খরচ কমানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। কারণ আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য বা স্প্র্রেডটা অনেকখানি কমে গেছে। এই সীমিত আয়ের মধ্যে খরচ সমন্বয় করা খুব কঠিন। তারপরও এসবের মধ্য দিয়েই মুনাফা করতে হবে। সব বাধাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সামনে আগাতে চাই।’
এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আর্থিক খাতও আমাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশ। সুতরাং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে খেলাপি বৃদ্ধি পাওয়া খাতের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এতে করে পুরোনোদের পাশাপাশি শেয়ার বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবে।’ তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে ঋণখেলাপিদের নানারকম সুবিধা দেয়া হচ্ছে। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজার উভয়ই। যেখানে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তৈরি হচ্ছে ও পরিচালকদের যোগসাজশে টাকা বের করে নেয়া হচ্ছে। তদন্তের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের সংশ্লিষ্টরা জানান, কভিডের আঘাত আসার আগে থেকেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ এমনিতেই বাড়ছিল। করোনার কারণে ঋণ আদায় ব্যাপক কমে গেছে। এতে করে টাকার প্রবাহ ব্যাপক কমেছে। এর মধ্যে আবার সাধারণ গ্রাহকের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সব মিলিয়ে চরম সংকটে আছে তারা। তারল্য সংকট কাটাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমডিদের সংগঠন বিএলএফসিএর পক্ষ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছে। তবে বিদ্যমান আইনে এ ধরনের তহবিল দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সিআরআর কমানো, শিথিল শর্তে প্রণোদনার অর্থ দেয়াসহ নানা নীতি সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।