ঢাকা শুক্রবার, অক্টোবর ১৮, ২০২৪
রিটের মাধ্যমে খেলাপি তালিকা থেকে বের হচ্ছেন
  • ব্যাংকবীমাবিডি
  • ২০২০-১২-২৮ ২১:১৩:১৭

একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) খেলাপিযোগ্য হলেও আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে তা নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ যথাসময়ে ঋণের কিস্তি ফেরত না দেওয়ার দায়ে ওই গ্রুপের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তালিকায় ওঠার কথা থাকলেও আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে সেটি হয়নি। বরং রিটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে গ্রুপটি ঠিকই খেলাপির তকমা থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নিয়মিত থাকার কারণে অন্য ব্যাংক থেকেও ঋণসুবিধা নিতে পারছে গ্রুপটি।

জানা যায়, সিআইবিতে যাতে নাম না ওঠে, সে জন্য আগে হাইকোর্টে রিট করতেন ঋণখেলাপিরা। ২০১৮ সালের শেষ দিকে আপিল বিভাগের আদেশে উচ্চ আদালতে এ ধরনের রিটের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ঋণখেলাপিরা থেমে নেই, এখন নতুন কৌশল হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে প্রথমে তাঁরা নিম্ন আদালতে একটি ঘোষণামূলক মামলা করেন। সেই মামলা খারিজ হয়ে গেলে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ নিম্ন আদালতে আদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেন। পরে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়তে থাকে। অর্থাৎ সিআইবিতে নাম অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে ঋণখেলাপিরা নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ করছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইচ্ছা করে ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণে কোনো আইন বা নীতিমালা বাংলাদেশে নেই। এ সুযোগে অনেকেই ঋণের টাকা যথাসময়ে ফেরত দেন না। উল্টো খেলাপির তকমা থেকে রেহাই পেতে কিংবা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর নিয়মিত থাকেন। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এ প্রকৃতির ঋণখেলাপিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছেন বলে মনে করেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঋণখেলাপিরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী। দেখা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই অনেকেই আদালতে রিট মামলা করে স্থগিতাদেশ নেন, কিন্তু স্থগিতাদেশ মানেই তিনি খেলাপি থেকে মুক্তি পেয়ে গেলেন, তা নয়। সাময়িক সময়ের জন্য রেহাই পেতে এই কৌশল প্রয়োগ করছেন অনেকেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো গ্রাহক দায়ের করা রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ দেওয়া হলে ওই ঋণটি শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে কোনো খেলাপিগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের খেলাপি দায়ের বিপরীতে হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ থাকাবস্থায় তার অনুকূলে নতুন ঋণ দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনা নেই। এ রকম গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এখতিয়ারভুক্ত। সূত্র বলছে, এই শিথিলতার কারণেই সুযোগ নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। ব্যাংকগুলোও আদালত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার বাইরে যেতে পারছে না।

২০১৪ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা ঋণ নেয় বস্ত্র খাতের একটি প্রতিষ্ঠান। যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ঋণটি খেলাপি হয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি তালিকায় খেলাপি হিসেবে নাম ওঠে প্রতিষ্ঠানটির। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সিআইবিতে নাম তালিকাভুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিম্ন আদালতে ঘোষণামূলক মামলা করলে আদালত তা খারিজ করে দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে দুই মাসের ব্যবধানে হাইকোর্টে সিভিল আপিল করে প্রতিষ্ঠানটি। হাইকোর্ট আবেদন মঞ্জুর করে নিম্ন আদালতের আদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। এতে সিআইবি তালিকা থেকে খেলাপি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নাম বাদ পড়ে। পরে ঋণটি পুনঃ তফসিলের সুযোগ পায় প্রতিষ্ঠানটি। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ এরই মধ্যে কয়েক দফা বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, এটা এখন জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ স্থগিতাদেশের কারণে এ প্রকৃতির ঋণগ্রহীতাদের খেলাপির পর্যায়ে নেওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা আদালতের স্থগিতাদেশ পান, তাঁদের কিন্তু খেলাপি বলতে পারবেন না। এ রকম বহু স্থগিতাদেশ ইস্যু হয়েছে, যেগুলোতে বিপুল অঙ্কের টাকা আটকা পড়ে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ঋণখেলাপিদের দায়ের করা রিট মামলার সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এসব রিট মামলায় সংশ্লিষ্ট টাকার পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থগিতাদেশ প্রায় দুই হাজার মামলার বিপরীতে আটকা আছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এই বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ঋণখেলাপিরা নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে প্রায় দুই হাজার আপিল করেন। এসব আপিলের মধ্যে ১৩৯টি বাদে বাকি সব ঋণখেলাপি হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন।

এদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ঋণ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ প্রজেক্ট প্রফাইল, গ্রাহকের ইকুইটি না থাকা, বন্ধকি সম্পত্তির মালিকানা সঠিক না হওয়া, প্রয়োজনের চেয়ে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম হওয়া ও বিচারকের অভাব এবং আইনি মতামতের জন্য ব্যাংকের আইনজীবীকে পর্যাপ্ত সময় ও সহায়ক জামানতের পর্যাপ্ত দলিলাদি সরবরাহ করতে না পারায় অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতেও দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৬০ হাজারের বেশি মামলা ঝুলে আছে। এসব মামলায় অনাদায়ি টাকার পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও বেশি।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কেউ যখন খেলাপি হয়, তখন টাকা আদায়ের জন্য আমরা অর্থঋণ আদালতে মামলা করি, কিন্তু ওই মামলা নিষ্পত্তিতে আট থেকে ১০ বছর লেগে যায়। এরপর অর্থঋণ আদালতের রায় মিললেও তা কার্যকরের জন্য আলাদাভাবে আবার জারি মামলা করতে হয়। সেখানে লেগে যায় আরো তিন থেকে পাঁচ বছর। এতে টাকা আদায় ও খেলাপিদের শাস্তি নিশ্চিত করা বিলম্বিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে খেলাপি হওয়া ঠেকাতে অনেকেই উচ্চ আদালতে রিট করেন।

সাউথইস্ট ব্যাংকে গ্রাহকের মতবিনিময় সভা
ব্যাংকগুলো শাখা খোলার পরিবর্তে ডিজিটাল মাধ্যমকে গুরুত্ব দিচ্ছে
আইএফআইসি ব্যাংক থেকে গ্রাহকের ২০ লাখ টাকা ছিনতাই, ২ পুলিশ গ্রেপ্তার