দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা গত কয়েক মাসের তুলনা অনেকটাই কম। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (২২ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর) মারা গেছেন ১৪ জন। এ নিয়ে সরকারি হিসাবে করোনায় মারা গেছেন পাঁচ হাজার ৭৬১ জন। দেশে করোনা মহামারির শুরুর দিকে মৃত্যুহার বেশি থাকলেও এখন কমে আসার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভাইরাসের অতিমাত্রায় মিউটেশনের কথা। তাদের মতে, করোনাভাইরাসের অতিমাত্রায় মিউটেশনের কারণে এর তীব্রতা কমেছে। যে কারণে সংক্রমণ অনেক ক্ষেত্রে বাড়লেও কমেছে মৃত্যুহার।
গত ৮ মার্চ প্রথম তিন জন করোনা রোগী শনাক্ত ঘোষণা দেওয়ার পর গত ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এদিকে সরকারি তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৫৮৬ জন। আর ২২ অক্টোবর শনাক্ত হয়েছিল এক হাজার ৬৯৬ জন। যা গত এক মাসের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক নতুন রোগী শনাক্তের রেকর্ড।
আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্ত রোগীর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম, মৃত্যু তালিকায় ৩১তম। অপরদিকে ভারতের অবস্থান আক্রান্ত রোগীর তালিকায় দুই, মৃত্যুতে তিন, পাকিস্তান আক্রান্তের তালিকায় ২৩ আর মৃত্যু তালিকায় ২৬। অপরদিকে সুস্থতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫ নম্বরে, পাকিস্তান ১৬, ভারত এক, সৌদি আরব ১৩, ইরান ১১ এবং ইরাক ১২ নম্বরে।
করোনাভাইরাসের মিউটেশনের বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেন্ট্রাল ফর মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজি বিভাগ গত ৩০ মার্চ থেকে সাত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থেকে ৩২৪টি করোনাভাইরাসের (সার্স কোভ-২) জিনোম সিকোয়েন্স করে। তারা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত দেশে এর চার হাজার ১৬০ বার মিউটেশন হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেন্ট্রাল ফর মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মারুফুর রহমান অপু বলেন, ‘স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে যে স্ট্রেইনগুলো বেশি ঘুরছে তার সংক্রমণ প্রবণতা বেশি। কিন্তু তার রোগের তীব্রতা কম এবং এ দিয়ে সম্ভবত ব্যাখ্যা করা সম্ভব বাংলাদেশে কেন মৃত্যুহার কম।’ তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়, আরও অনেক কারণ থাকতে পারে বলেও মন্তব্য তার।
গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত মিউটেশন হচ্ছেন স্পাইক প্রোটিনে (D614G) মিউটেশন। মূলত ইউরোপে ডমিনেন্ট হওয়া এই মিউটেশনটি বর্তমানে সারা বিশ্বেই মূল ধরন (প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এই মিউটেশনধারী ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে)। বাংলাদেশে শতকরা ৯৭ শতাংশ নমুনাতেই এই মিউটেশনটি আছে। আর এর ফলে ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বেড়ে যায়।
তবে কিছু গবেষণা বলছে, বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়লে বিপরীতক্রমে রোগের তীব্রতাও কমে, যদিও D614G-এর কারণে মৃত্যুর হার বাড়ে না কমে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, কেবল করোনা বলে নয়, পৃথিবীতে যেকোনও ভাইরাসই মিউটেশন হলে দুর্বল হতে থাকে, এজন্য সব সময় ভাইরাল ডিজিজগুলো থেকে যায়।
তিনি বলেন, মহামারি তৈরির সময় অনেক মানুষ মারা গেলেও ধারাবাহিকভাবে কোনও ভাইরাল ডিজিজেই লাখ লাখ মারা যায় না, ধীরে ধীরে তার ভিরুলেন্স কমে যায়। তবে এটা কেবল সে ভাইরাসের ক্ষেত্রেই হবে, সেখানে ইনফেকশন বা সংক্রমণ অনেক মানুষের মধ্যে হবে…, যেহেতু রোগী অনেক বেশি হলে চাপ অনেক বেশি, অনেক ডাইভার্স চাপ হলেই তখনই এটা হবে। যদি অল্প মানুষের মাঝে সংক্রমণ হয়, সে ধরনের ভাইরাসের ক্ষেত্রে ভিরুলেন্স কমে না, থেকেই যায়।
আর ভিরুলেন্স কমলে তার স্প্রেড করার সামর্থ্য অর্থ্যাৎ তার বিস্তার লাভের ক্ষমতা বাড়ে, এটা প্রায় সব ভাইরাসের ক্ষেত্রেই সত্য, এখানেও তাই হয়েছে, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান।
তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমি যতদূর জানি, এ ভাইরাসের তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন হয়নি যে এর চরিত্র পরিবর্তন হয়ে যায়।
তিনি বলেন, এটা রুটিন পরিবর্তন। দেশ থেকে দেশে ভাইরাসের তীব্রতা, ভাইরাসের ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তবে অন্যান্য ভাইরাসের বেলাতেও ইনকোর্স অব টাইম দুর্বল হয়ে পড়ে—সেটা কয়েক মাসেই সম্ভব না বলা। তবে এটাও হতে পারে, কিন্তু এটা বলার জন্য আরও সময় লাগবে।
তবে সংক্রমণ এবং মৃত্যু কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মানুষের আচরণ পরিবর্তন হয়েছে। মৃত্যু ঠেকানোর যেসব বিষয় প্রথমদিকে জানা ছিল না, এখন সেগুলো জানা হয়ে গেছে—যেমন হাইফ্লো অক্সিজেন ও চিকিৎসা না পাওয়া।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ইউরোপে সংক্রমণ অনেক বেড়েছে, কিন্তু সে তুলনায় মৃত্যু অনেক বাড়েনি। আমেরিকাতেও মৃত্যু কমেছে। তবে আফ্রিকাতে মৃত্যু বাড়ছে। সারা পৃথিবীতেই মৃত্যু কমে আসছে, চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে বলে। একইসঙ্গে মানুষ এই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য আচরণগত পরিবর্তনে আগের চেয়ে অনেক বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বলে জানান তিনি।
সংক্রমণের তীব্রতা কমেছে বা কমে আসছে—এরকম কারণ আমার জানা নেই, যোগ করেন ডা. মুশতাক হোসেন।
এদিকে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, পুরো বিশ্বেই এখন সব স্ট্রেইনই D614G। তবে বাংলাদেশে কেন মৃত্যুহার এখনও কম, সে উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাসের গঠনগত কোনও কারণেই মৃত্যুহার কম।
তিনি বলেন, করোনার তীব্রতা কমেছে। তবে সেটা কেন কম, সে উত্তর এখনও নাই। এর জন্য আরও গবেষণা দরকার। এখন পর্যন্ত সিগনিফিকেন্ট বা ক্লিনিক্যাল কিছু পাওয়া যায়নি।
তবে এই মিউটেশনের কারণে সংক্রমণ প্রবণতা বেশি হলেও মৃত্যু হার কম, অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা অবজারভেশনে বোঝা যাচ্ছে, বলেন ডা. জাহিদুর রহমান।
এ গবেষণা কাজে ডা. মারুফুর রহমান ছাড়া আরও যুক্ত ছিলেন আইসিডিডিআর,বি’র গবেষক ডা. শারমিন বিনতে কাদের এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখার ডা. এস এম শাহরিয়ার রিজভী।
ডা. এস এম শাহরিয়ার রিজভী বলেন, করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন D614G-এর ইনফেকশন করার প্রবণতা বেশি। কিন্তু এর সঙ্গে মৃত্যুহার নিয়ে কনফিউশন রয়েছে। তবে যদি এমন রোগীর প্রোফাইলসহ স্টাডি করা যেতো, তাহলে অনেক কিছু আরও ভালো করে বোঝা যেতো বলে জানান তিনি।