বাংলাদেশ ব্যাংক একের পর এক সিদ্ধান্ত নিলেও তাতে সংকট কমেনি, বরং জটিলতা বেড়েছে। ফলে আগের অবস্থান থেকে সরে এবার তারা জানিয়েছে, ডলারের দাম নির্ধারিত হবে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে।
ব্যাংকগুলো নিজেই এই দাম নির্ধারণ করবে। প্রবাসী ও রপ্তানি আয়, আমদানি বিল নিষ্পত্তিসহ প্রতিটি লেনদেনে ডলারের দাম হবে পৃথক। তবে সব ব্যাংক প্রতি লেনদেনেই একই দামে ডলার কেনাবেচা করবে। আর কেনাবেচায় মুনাফা হবে সর্বোচ্চ এক টাকা।
ডলারের এই দাম নিয়মিত ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক তা পর্যবেক্ষণ করবে ও নিয়মিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে তথ্য–উপাত্ত বিনিময় করবে। ডলারের সংকট ও বাজারের অস্থিরতা কাটাতে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা আগামী সোমবার থেকে কার্যকর হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলারের দাম ৯৫ টাকা কোথায় থাকবে, সে বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সভা হয়। সভায় এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের সভাপতিত্ব ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানসহ এবিবি ও বাফেদার নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সভার শেষ পর্যায়ে যোগ দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এবিবির পক্ষে চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন, বাফেদার পক্ষে চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিমসহ দুই সংগঠনের কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভও গতকাল আরও কমেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ১৭৩ কোটি ডলারের বিল পরিশোধের পর গতকাল রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭০৬ কোটি ডলার। গত বছরের শেষের দিকে রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার পর্যন্ত উঠেছিল।
গতকালের সভা শেষে বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, সভায় ডলারের বাজার পর্যালোচনা করা হয়েছে। আগামী রোববার এবিবির সঙ্গে বসে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হবে। নতুন দাম সবাই মেনে চলবে। এতে বাজারে অস্থিরতা কাটবে।
সভার সিদ্ধান্ত
বাজারের অস্থিরতা কাটাতেই গতকাল ডাকা সভায় ডলারের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে আলোচনা হয়। এতে ব্যাংকগুলো তুলে ধরে ডলার জোগানের প্রক্রিয়া ও দামের বিষয়। এ ছাড়া আমদানি দায় পরিশোধের বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও তুলে ধরে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলার কেনাবেচায় এক টাকার বেশি মুনাফা না করার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে আগামী সপ্তাহে ডলার–বাজার নিয়ে একটি পর্যালোচনা ও ডলারের দামের হিসাব জমা দিতে বলা হয়। নতুন দামে সব ব্যাংক লেনদেন করবে বলে জানানো হয়।
সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ডলারের দাম ঠিক হবে। বাফেদা ও এবিবি এটা নির্ধারণ করবে। সব ব্যাংক তা মেনে চলবে। তারা আমাদের জানাবে, আমরা শুধু পর্যবেক্ষণ করব।’
তবে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের চাহিদা বাড়লে বেশি দামে না কিনে উপায় নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সব ব্যাংককে সময়মতো ডলার–সহায়তা দেয়, তাহলে নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তা ছাড়া এই সিদ্ধান্ত বেশি দিন টিকবে না। এর আগেও ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারও এমনটি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সংকট ও বাজার পরিস্থিতি
গত মে মাস থেকে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় দিয়ে ডলারের চাহিদা মিটছে না। এতে সংকট তৈরি হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ঋণ পরিশোধ, জাহাজ ও বিমানভাড়া, প্রযুক্তি ও সেবা খাতে বিদেশি বিল, শিক্ষা–চিকিৎসাসহ আরও নানা খাতে ডলারের খরচ। আমদানি কমাতে নানা পদক্ষেপের ফলে ঋণপত্র খোলা কমেছে, বেড়েছে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ও।
ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। ইতিমধ্যে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৯৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও ব্যাংকগুলোতে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে আরও অনেক দামে।
ব্যাংকগুলো গতকালও আমদানিতে ডলারের দাম নিয়েছে ১০৭ টাকা পর্যন্ত। প্রবাসী আয় এনেছে ১১২ টাকা পর্যন্ত দামে ও রপ্তানি আয় নগদায়ন করেছে ১০৩-১০৪ টাকা দামে।
ডলার কেনাবেচায় অতি মুনাফা করায় এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ১৩ ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ছয় ব্যাংকের এমডিদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে, সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের।
এই ব্যাংকগুলো হলো স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, প্রাইম, ব্র্যাক, দি সিটি, ডাচ্-বাংলা ও সাউথইস্ট ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাখ্যা চাওয়া ব্যাংকগুলো হলো এইচএসবিসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), এনসিসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ইস্টার্ণ ব্যাংক।
এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি ব্যাংকগুলো দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে আনছে। অনেক ব্যাংক ঋণসীমা কমিয়ে এনেছে। বাড়িয়ে দিয়েছে মাশুল ও ঋণের সুদহার। ফলে খরচ বাড়ছে আমদানিতে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে সব ব্যাংকের জন্য একই দর নির্ধারণ করা হচ্ছে।