চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হয়েছে। আর খেলাপি না হওয়া বা অশ্রেণীকৃত ভালো মানের ঋণে খাতভেদে সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয় দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বাইরে নতুন করে আরও ১ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে মুনাফার ক্ষেত্রে চাপে পড়তে যাচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলো। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে।
ব্যাংকাররা বলছেন, সুদহার কমায় এমনিতেই ব্যাংকের মুনাফা কমে গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত ও নতুন করে কেউ খেলাপি না হওয়ায় ব্যাংকের মুনাফা বাড়তে শুরু করেছিল। এখন নতুন করে ১ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হলে মুনাফায় বড় ধাক্কা আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা কার্যকর করতে হলে নতুন করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এতে অনেক ব্যাংক লোকসানে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্যাংকের মুনাফা কমে গেলে বা লোকসানে চলে গেলে তার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে শেয়ারবাজারেও। কারণ, শেয়ারবাজারের সূচক ও বাজার মূলধনে ব্যাংক খাতের প্রভাবই বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার মধ্যে অনেক ব্যাংকের মুনাফা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে, যেটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। এই সময়ে বিশেষ ছাড়ের কারণে এই মুনাফা ফুলে ফেঁপে গেছে। যার বড় অংশই কাগুজে বা কৃত্রিম। তাই এই মুনাফা ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেলে ভবিষ্যতে বড় সমস্যা দেখে দেবে। এ কারণে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, করোনার কারণে ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ কারণে চলতি বছর নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হচ্ছে না। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে মুনাফা থেকে অতিরিক্ত হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতিও (প্রভিশনিং) রাখতে হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর কাগুজে মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বমুখী মুনাফায় কিছুটা লাগাম টেনে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বিশেষ হিসাবে থাকা বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টের (এসএমএ) ঋণ ও সব ধরনের ভালো ঋণের ওপর অতিরিক্ত ১ শতাংশ হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) রাখতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো তাদের কোন ধরনের ঋণের সুদকে আয় খাতে নিতে পারবে, তা–ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই চলতি বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। চলতি ডিসেম্বরের ব্যাংকগুলোর আর্থিক বছর শেষ হবে। বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঘোষিত হবে লভ্যাংশ।
এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কেউ বলছেন, করোনার মধ্যে যেসব ঋণ আদায় হচ্ছে, তার বিপরীতে নতুন করে কেন নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে, তা বোধগম্য নয়। আবার কেউ বলছেন, যেসব ঋণ আদায় হচ্ছে না, তার বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার উদ্যোগটি ভালো। ফলে প্রকৃত সিদ্ধান্তটি কী, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েই যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব ঋণের ওপর নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে। এটাই সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। প্রয়োজনে আরও বিস্তারিত জানানো হবে।
বর্তমানে অশ্রেণীকৃত বা ভালো এসএমএ ঋণের ওপর দশমিক ২৫ শতাংশ, পেশাদারদের ভোক্তা ঋণে ২ শতাংশ, আবাসনে ১ শতাংশ, অন্য ভোক্তা ঋণে ৫ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। এ ছাড়া কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণে ১ শতাংশ, ক্রেডিট কার্ডে ২ শতাংশ, স্টক ডিলার ঋণে ২ শতাংশ ও সব ধরনের বিনিয়োগের ওপর ১ শতাংশ হারে সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। এ ছাড়া খেলাপির মানভেদে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার ৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত।
গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ঋণ ৯ লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ও এসএমএ ঋণ ৪৪ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ৯ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সেপ্টেম্বর শেষে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বাড়তি সঞ্চিতির এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ১৫ শতাংশ গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি দিতে পারছে না। এর মধ্যে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানই বেশি। তাদের ঋণে আমাদের অতিরিক্ত ১ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে। ভবিষ্যতে এসব ঋণ খারাপ হতে পারে, এ জন্য কিছুটা আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করা যাবে।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, যেসব ঋণ আদায় হচ্ছে না, তার সুদ আয় খাতে নিতে বিভিন্ন পর্যায়ের অনুমোদন নিতে হবে। এর মধ্যে পরিচালনা পর্ষদ ১০ কোটি টাকার বেশি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণের সুদ আয় খাতে নেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেবে। পাশাপাশি এসব তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই করতে পারে বলে জানানো হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো চাইলেও আগের মতো সব ঋণ থেকে আয় দেখাতে পারবে না।