করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালজুড়ে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ছিল। এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়। আর পুরো বছর ঋণ পরিশোধে ছিল বিশেষ ছাড়। এতে প্রায় সব ব্যাংকের সুদ থেকে নিট আয় কমে যায়। তবে ট্রেজারি ব্যবসা ভালো হওয়ায় বিনিয়োগ থেকে আয় বৃদ্ধি পায়। আর গ্রাহকদের বিশেষ সুযোগ দেওয়ার ফলে নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। যে কারণে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণেরও দরকার পড়েনি। সব মিলিয়ে বছর শেষে অধিকাংশ ব্যাংকেরই নিট মুনাফা বেড়েছে। নিট মুনাফাই হলো প্রকৃত মুনাফা। পরিচালন মুনাফা থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও কর দেওয়ার পর এই হিসাব হয়।
বিভিন্ন ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছর ব্যাংকগুলোয় আমানত যে হারে বেড়েছে, সেই তুলনায় তাদের সুদ ব্যয় কম হয়েছে। কারণ, ঋণের সুদহার কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদও কমিয়েছে তারা। ঋণের সুদ কমায় ব্যাংকগুলোর আয় কম হয়েছে, ঋণ আদায়ও অনেক কমেছে। এ ছাড়া পে-অর্ডার, গ্যারান্টি, টাকা পাঠানো, স্কুল-কলেজের বেতন গ্রহণ, ডলার এনডোর্সমেন্ট এবং সরকারি বিভিন্ন সেবা মাশুল গ্রহণ থেকে ব্যাংকগুলোর নিয়মিত যে আয় ছিল, সেটি করোনার কারণে কমে যায়।
অন্যদিকে করোনার কারণে অনেক ব্যাংকের পরিচালন খরচও কম হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের সভার ফি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পেছনে খরচ কমেছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে ও অন্যান্য সেবা থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আয় করেছে। এর ওপর নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় পাওয়ায় বছর শেষে ভালো মুনাফার মুখ দেখেছে অধিকাংশ ব্যাংক। তবে কিছু ব্যাংক করোনার কারণে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করায় তাদের মুনাফা কম হয়েছে বা লোকসান হয়েছে। সার্বিকভাবে অবশ্য ব্যাংক খাত ২০২০ সালে মুনাফা অর্জন করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা, যা ২০১৯ সালে ছিল ৬ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৮ সালে নিট মুনাফা ছিল ৩ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা এবং ২০১৭ সালে ৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
গত বছর করোনার মধ্যেও ওষুধ, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা, খাদ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রীসহ কয়েকটি খাত ভালো ব্যবসা করেছে। বিশেষ করে এসব খাতে যেসব ব্যাংকের ঋণ আছে, তারা নিয়মিত কিস্তি ফেরত পাওয়ায় সুদ বাবদ ভালো আয় করতে সক্ষম হয়েছে বলে ব্যাংকাররা জানান।
তবে ছাড় থাকায় অন্য কয়েকটি খাতের অনেক ঋণের বিপরীতে নিয়মিত সুদ-কিস্তির টাকা ব্যাংকগুলো পায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেননি ঋণগ্রহীতারা। কেবল ৩৬ হাজার ৭১১ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে কিছু কিস্তি পরিশোধ করেন গ্রাহকেরা।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও সরকারি খাত মিলিয়ে ৩২টি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিটি ব্যাংকের নিট মুনাফা ২০১৯ সালের ২৪৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ৪০১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। গত বছর ব্যাংকটির খরচ যেমন কমেছে, সুদ থেকে নিট আয়ও কমেছে। তবে বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়ায় মুনাফা বৃদ্ধির শীর্ষে উঠেছে ব্যাংকটি।
জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, গত বছর আমানতের খরচ কমে আসার পরও আমানত বেড়েছিল ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বেশি খরচের স্থায়ী আমানত কমেছিল ৯৭০ কোটি টাকা। আর ফি ও কমিশন আয়ই ছিল মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় গত বছর কমেছিল ২৯ কোটি টাকা। সর্বোপরি করপোরেট সুশাসন, সৎ ও দক্ষ পরিচালনা পর্ষদের পেশাদারি সমর্থন ও সিটি ব্যাংকের শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজের কারণে এই নিট মুনাফা করা সম্ভব হয়।
আলোচ্য সময়ে পূবালী ব্যাংকের মুনাফা ২২০ কোটি থেকে বেড়ে ৩৬৭ কোটি, ডাচ্-বাংলার ৪১১ কোটি থেকে ৫২৮ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটির ২০৬ কোটি থেকে ২৭৯ কোটি ও সোনালীর ২৭১ কোটি থেকে বেড়ে ৩২৩ কোটি টাকায় উঠেছে।
জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিউল আলম খান চৌধুরী বলেন, গত বছর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় মুনাফা কমেছে। তবে বিনিয়োগ করে ভালো আয় হয়েছে। ঋণ খেলাপি হয়নি, তাই নিরাপত্তা সঞ্চিতি কম লেগেছে। এর ফলে মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আলোচ্য সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মুনাফা বৃদ্ধি পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, এবি, উত্তরা, এনসিসি, এসআইবিএল, প্রাইম, ইস্টার্ণ, ইউসিবিএল, ব্যাংক এশিয়া, যমুনা, এক্সিম, শাহ্জালাল, ইসলামী ও অগ্রণী।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ১১টি ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে। মুনাফা কমার শীর্ষে ছিল আইএফআইসি ব্যাংক। ব্যাংকটির নিট মুনাফা কমেছে ১৮৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এটির নিট মুনাফা হয় ৫৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্র্যাক, ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংকেরও নিট মুনাফা কমেছে গত বছর।
আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ আলম সারওয়ার বলেন, ‘গত বছর সুদের হার হঠাৎ কমিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে আমরা সাধারণ আমানতকারীদের সুদের হার সেভাবে কমাইনি। এ কারণে মুনাফা কমে যায়।’
মুনাফা কমার তালিকায় থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হচ্ছে সাউথইস্ট, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, মার্কেন্টাইল, রূপালী, ওয়ান, ট্রাস্ট, স্ট্যান্ডার্ড ও প্রিমিয়ার ব্যাংক। এদিকে সম্প্রতি মেয়াদি আমানতের সুদহার বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলোর সুদ ব্যয় বাড়তে শুরু করেছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেওয়া সুদে ব্যাংকগুলো আমানত রাখছে ও ঋণ দিচ্ছে, যেটাকে ব্যাংকাররা ‘হুকুমের সুদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।