নিয়মিতভাবে যাঁরা প্রচুর কেনাকাটা ও ঘোরাঘুরি করতেন, তাঁরা খরচের হাত গুটিয়ে রেখেছেন। প্রবাসীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। তাঁদের পাঠানো ডলার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে নগদ টাকা দিচ্ছে। এভাবে ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত নগদ টাকার পরিমাণ বাড়ছে। আমানতের সুদহার কম হলেও সব টাকাই বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা জমা আছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা একেবারেই অলস। বাকি টাকায় কেনা হয়েছে বিভিন্ন বিল ও বন্ড। অনেক ব্যাংক অলস টাকার অপব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে একবারে অলস পড়ে আছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অলস এ অর্থের বিপরীতে কোনো সুদ পায় না ব্যাংক। এতে করে অধিকাংশ ব্যাংক এখন আমানত নিতে অনীহা দেখাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর বাজারে তারল্য বাড়াতে নানা নীতিসহায়তা দিলেও ঋণ চাহিদা বাড়েনি। যে কারণে অলস অর্থ বাড়ছে।
কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি প্রণোদনার বাইরে ব্যাংকগুলোর তেমন ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। কারণ, ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। তাঁরা অনুকূল সময়ের অপেক্ষায় আছেন। ফলে ব্যাংকগুলোতে অলস তারল্যের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
ব্যাংকগুলো এখন জমতে থাকা টাকা সরকারের বিভিন্ন বন্ড ও অন্যান্য ব্যাংকের বন্ডে বিনিয়োগ করে আমানতের খরচ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সেখানেও চাহিদামতো বিনিয়োগ করতে পারছে না। ঋণের চাহিদা না থাকায় অনেক ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যদিও সুদের হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। আবার অনেক ব্যাংক ঋণের সুদ কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহারও কমিয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। এতে সুদ আয়ের ওপর নির্ভরশীল আমানতকারীদের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলোও তারল্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কঠিন সময় পার করছে।
দেশের মুদ্রাবাজারে অলস তারল্য এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চে। এ অলস তারল্যের চাপ থেকে ব্যাংকগুলোকে সুরক্ষা দিতে উদ্যোগী হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য মাসব্যাপী বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম শুরু হচ্ছে আগামীকাল। ৭, ১৪ ও ৩০ দিন মেয়াদি এসব বিলের মাধ্যমে শুরু হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজার থেকে অলস তারল্য তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া।
অতিরিক্ত তারল্যের কুফল থেকে মুদ্রাবাজারকে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দুই হাতিয়ার রিভার্স রেপো ও স্বল্পমেয়াদি বিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে রিভার্স রেপোর বিকল্প হাতিয়ার হিসেবে স্বল্পমেয়াদি বিলকে কাজে লাগাতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে একেবারে অলস অবস্থায় ছিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ অলস তারল্যের নেতিবাচক নানা প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতিতে। ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমেছে বেসরকারি ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার। কলমানির সুদহারও নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। এ অবস্থায় বিনিয়োগের বিকল্প উৎস খুঁজতে গিয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা ঢালতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে মুদ্রাবাজারে সৃষ্টি হওয়া অভূতপূর্ব এ পরিস্থিতি সামাল দিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিলের নিলামে অংশ নিতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের সবক’টি তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই নয়টি নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। এর প্রথমটি হতে যাচ্ছে আগামীকাল। ৭, ১৪ ও ৩০ দিন মেয়াদি এসব বিলের ইল্ডহার নির্ধারিত হবে ব্যাংকগুলোর বিডিংয়ের ওপর। অর্থাৎ বিলের চাহিদার ভিত্তিতেই অকশন কমিটি ইল্ডহার নির্ধারণ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তথ্য বলছে, ২ আগস্ট ৯১ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ১ হাজার কোটি টাকা তোলা হয়। ওইদিন এ বিলের ইল্ডহার ছিল দশমিক ৫৫ শতাংশ বা ৫৫ পয়সা। একই দিন অনুষ্ঠিত ৩৬৪ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ইল্ডহার ছিল ১ দশমিক ২৪ শতাংশ। এরপর ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের নিলামে ইল্ডহার ছিল ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। যদিও দুই বছর আগেও এ ধরনের বিল ও বন্ডের ইল্ডহার ৫ শতাংশেরও বেশি ছিল। বর্তমানে কলমানি বাজারের সুদহারও ১ শতাংশের নিচে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের ইল্ডহার ১ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, সুদহার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের প্রতি ব্যাংকগুলো আগ্রহী হবে না। বিনিয়োগের বিকল্প উৎস সামনে থাকলে কোনো ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংক বিল কিনবে না।