খেলাপি ও অনাদায়ী কিস্তির বিপরীতে আরোপিত সুদকে আয় দেখানো হয়েছে। আদায় না হলেও এ সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফায় যোগ করা হয়েছে। রাখা হয়নি নির্দিষ্ট হারে সঞ্চিতি (প্রভিশন)। এভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। আর এ প্রতিবেদনে আপত্তি জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তির কারণে ছয় মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ২০২০ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত পূরণ করে অবশেষে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পেরেছে সোনালী ব্যাংক। একাধিক সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বছর শেষ হলে নতুন বছরের পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন (নিরীক্ষিত) প্রকাশ করতে হয়। কোনো কারণে এ সময়ের মধ্যে হিসাব শেষ করতে না পারলে অতিরিক্ত দুই মাস সময় চেয়ে নিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে। কিন্তু এবার কভিড মহামারির জন্য এর বাইরেও অতিরিক্ত সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ হিসাব চূড়ান্ত করতে ছয় মাস সময় দেয়া হয়, যা শেষ হয় গত জুন মাসে। এরপর আর সময় বাড়ায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
সময়মতো প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিমানার শিকার হতে পারে ব্যাংক দুটি। চূড়ান্ত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন ও তা পত্রিকায় প্রকাশ করতে ডাকা হয় ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম)। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হওয়ায় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাই এতে অংশ নেন। শতভাগ শেয়ারের মালিকানাই রাষ্ট্রের হাতে। কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত না হওয়ায় এখনও এজিএম করতে পারেনি জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক।
২০২১ সালের অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ২০২০ সালের হিসাব চূড়ান্ত করতে দেরি হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের শাখা প্রত্যন্ত এলাকায়ও রয়েছে। কভিড মহামারির কারণে অনেকেই নিয়মিত অফিস করতে পারেননি। এজন্য কিছুটা সময় লেগেছে। প্রভিশন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছি। এ জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়ে গেছে। শিগগিরই তা অনুমোদন হতে যাচ্ছে।’
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বার্ষিক হিসাব বিবরণীতে ব্যাংকের সব খাতের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হয়। এ জন্য প্রতিটি খাতকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে বছর শেষে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। একাধিকবার সতর্কও করা হয় ব্যাংকগুলোকে।
এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও ব্যাংকগুলোকে বলা হয়, আয় না হলে কোনো হিসাব আয় খাতে দেখানো যাবে না। সর্বশেষ সব ব্যাংকের উদ্দেশ্যে একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে আগেও জারি করা প্রজ্ঞাপনের উল্লেখ করে বলা হয়, আরোপিত বা অনারোপিত সুদ যাই হোক না কেন, আবার ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো আয় খাতে দেখানো যাবে না। কিন্তু এসব বিধিবিধান মানেনি ব্যাংক তিনটি। এতে আপত্তি জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে কাটছাঁট করা হয় অনেক খাতের আয় বিবরণী। যেগুলো প্রকৃত অর্থে ব্যাংকগুলো বুঝে পায়নি গ্রাহকের কাছ থেকে। বেঁধে দেয়া হয় বিভিন্ন শর্ত।
এসব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে তিনটি ব্যাংকেরই প্রস্তাবিত আয় কমে গেছে। গত জুনের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি ব্যাংকের হিসাব কাটছাঁট করে অনুমোদন দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত
সোনালী ব্যাংক দ্রুত হিসাব তৈরি ও এজিএম সম্পন্ন করেছে। আর্থিক প্রতিবেদনও চূড়ান্ত করতে পেরেছে ইতোমধ্যে।
এতে দেখা যায়, ২০২০ সালে ব্যাংকটির মুনাফা হয়েছে ৩৩২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে যা ছিল ২৭৪ কোটি টাকা। যদিও ২০২০ সালে ব্যাংকটির সুদ বাবদ আয় কমেছে ৪২৯ কোটি টাকা। কিন্তু সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১৮২ কোটি টাকা।
জানা গেছে, মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে গিয়ে নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑযে কোনো ঋণখেলাপি হওয়ার প্রাথমিক স্তরে গেলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের নামে নতুন ঋণ সৃষ্টি করা হয়। নতুন সৃষ্ট ঋণ থেকে পূর্বের ঋণের কিস্তি ও সুদ কেটে বাকি অর্থ বিতরণ করা। একই কৌশল অবলম্বন করা হয়, খেলাপি হওয়া ঋণ পুনঃতফসিলের বেলায়ও। ডাউনপেমেন্টের অর্থ নগদ আদায় না করে তার নামে ভিন্ন আরেকটি ঋণ সৃষ্ট করা হয়। সেই অর্থ দিয়ে পরিশোধ করা হয় ডাউনপেমেনেটর অর্থ। ঋণটি পুনঃতফসিল হলে আবার চলতি মূলধন দেয়া হয়।
যে কোনো নিয়মিত ঋণের বিপরীতে চলতি মূলধন দিতে পারে ব্যাংক। ব্যবসা সচল রাখতেই এ ঋণ দেয়া হয়। চলতি মূলধনের ঋণের একটি অংশ গ্রাহকের কাছে চলে যায়। এভাবে গ্রাহকের লাভ হয় নতুন কিছু অর্থ পাওয়া। ঋণটি নিয়মিত হওয়া। আবার ব্যাংকের সুবিধা হলো ঋণটি খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচল। কাগুজে হিসাবে কিছু অর্থ আদায় দেখাতে পারল। বাস্তবে ঋণের দায় বৃদ্ধি হয়ে যায়। পরবর্তীতে এ ঋণ আরও বেশি অর্থ নিয়ে খেলাপিতে পরিণত হয়। এভাবেই বাড়ছে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর সঙ্গে আরোপিত সুদের পরিমাণও বাড়ছে ধাপে ধাপে।