করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আবার শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের তৈরী পোশাকের প্রধান বাজারগুলোতে বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক দেশেই নতুন করে লকডাউন দিয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের তৈরী পোশাক খাতসহ রফতানি আয়ে। আয় কমে যাওয়ায় যারা ব্যাংকের অর্থ নিয়মিত পরিশোধ করতেন, তারা আর সময় মতো অর্থ ফেরত দিতে সক্ষমতা হারাচ্ছেন। এতে বিপাকে পড়ছে ব্যাংকিং খাত।
জানা গেছে, গত বছর মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর রাতারাতি রফতানি আয়ের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। দেশের তৈরী পোশাক খাতের প্রধান বাজার ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। বলা যায় এসব দেশে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের ৭০ ভাগ রফতানি হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রধান ক্রেতাদের অনেকেই রফতানি আদেশ বাতিল করে দেন। আবার কোনো কোনো ক্রেতা রফতানি আদেশ স্থগিত রাখেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের রফতানিখাতসহ অর্থনীতিতে। বেতন দিতে না পেরে অনেকেই পোশাক কারখানা বন্ধ করতে থাকেন।
এক ব্যবসায়ী জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই পোশাক খাতের অবস্থা ভালো ছিল না। এতে রফতানি আয় প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছিল। এর ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রায় সবগুলো রফতানি আদেশই প্রথমে স্থগিত করা হয়। পরে দুই দিনের মাথায় রফতানি আদেশগুলো বাতিল করা হয়। ক্রেতাদেশগুলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের পোশাক রফতানি আদেশ বন্ধ করে দেয়। অনেক অনুরোধ করার পরেও বাতিলাদেশ স্থগিত করা হয়নি। এর ফলে তার কারখানার সব শ্রমিক কাজহীন হয়ে পড়েন। এমনিতেই ব্যবসা মন্দার কারণে মুনাফার মার্জিন কমে গিয়েছিল। এতে কোনো মতে দিন পার করছিলেন, এর ওপর রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যাওয়ায় তারা চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যান। এমনি পরিস্থিতিতে অনেক কারখানাই বন্ধ হতে থাকে।
আপৎকালীন সঙ্কট মেটাতে সরকার তৈরী পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতনভাতা পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে। গত মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অর্থমন্ত্রণালয়ের বাজেটের বরাদ্দ হতে সচল রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা তহবিল নামে একটি তহবিল গঠন করে। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন দিতে সরকার বাজেট থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এ জন্য গঠন করা হয় বিশেষ প্রণোদনা তহবিল। ২ শতাংশ সুদে এ তহবিল থেকে শিল্পমালিকরা ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেন। আর ঋণ পরিশোধের জন্য ৬ মাসের গ্রেসপিরিয়ডসহ ২ বছরের সময় দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় এ তহবিলের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা বেতনভাতা পরিশোধের জন্য প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন। প্রথমে গ্রেস পিরিয়ড ৬ মাস ছিল। সে অনুযায়ী গত জানুয়ারি থেকে ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আবার শুরু হয়েছে। প্রধান বাজারগুলো আবারো লকডাউনে চলে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে আবারো বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছেন রফতানিমুখী শিল্প উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে ঋণ পরিশোধে তারা অপারগতা প্রকাশ করে গ্রেসপিরিয়ডের সময়সীমা এক বছর বাড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন তারা। তাদের অনুরোধে এক বছরের পরিবর্তে গ্রেসপিরিয়ডের সময়সীমা ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ আগামী জুন পর্যন্ত তারা ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি হবেন না।
এ দিকে ব্যবসায়ীদের চলমান পরিস্থিতি এ সুবিধা দেয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে ব্যাংকিং খাত নিয়ে। কারণ, ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে তা অপেক্ষাকৃত বেশি মুনাফায় আবার উদ্যোক্তাদের মাঝে বিনিয়োগ করেন। নির্ধারিত সময় শেষে আমানতকারীদের অর্থ মুনাফাসহ ব্যাংককে ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ঋণগ্রহীতারা ঋণের অর্থ ফেরত না দিলে বেকায়দায় পড়ে যায় ব্যাংকিং খাত। গত বছর কোনো অর্থ পরিশোধ ঋণগ্রহীতারা পরিশোধ না করেই পার করেন। তাদের অনুরোধ এ সুযোগ আরো তিন মাস অর্থাৎ মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এভাবে ঋণের অর্থ ফেরত না এলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া ব্যাংকের কঠিন হয়ে পড়বে। কমে যাবে ব্যাংকের আয়। সব মিলিয়েই বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ব্যাংকারদের।