বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) এক ডেপুটি গভর্নরসহ পাঁচ কর্মকর্তা পিকে হালদারের সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অবৈধ সুবিধা দেওয়ার নামে হালদারের কাছ থেকে তারা ঘুষ নেন সাড়ে ৬ কোটি টাকা।
জালজালিয়াতির তথ্য গোপন করে তারা পিকের পক্ষে নিরীক্ষা রিপোর্ট দেন। এদের কাঁধে ভর দিয়ে বছরের পর বছর আর্থিক খাতে জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতি করে গেছে পিকে হালদার-চক্র।
ঘুসের বিষয়টি নথিতে ‘কিছু ভিআইপির জন্য মূল্যবান গিফট ক্রয় করা হয়েছিল’ মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া অডিট প্রতিবেদনেও (হুদা ভাসি প্রতিবেদন) এর উল্লেখ আছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে গ্রেফতার পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী সোমবার ঢাকার সিএমএম আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা তুলে ধরেন।
কাছ থেকে দেখা পিকে হালদারের অনিয়ম-দুর্নীতির সাক্ষী উজ্জ্বল কুমার নন্দীকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সোমবার আদালতে হাজির করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতিকুল ইসলাম পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী ২০০৮ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে যোগদান করেন। এখানে চাকরি সূত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন ডিএমডি পিকে হালদারের সঙ্গে পরিচয়। উজ্জ্বল কুমার নন্দী স্বীকার করেন, পরিচয়ের সূত্র ধরে পিকে হালদার তাকে ব্যবহার করেছেন।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, পিকে হালদার ২০১৪ সালের দিকে চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম চৌধুরীর কাছে ১২৭ কোটি টাকা দিয়ে কক্সবাজার রেডিসন হোটেলটি ক্রয় করেন। চেয়ারম্যান হন পিকে হালদার নিজে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান, অমিতাভ অধিকারী, রতন কুমার বিশ্বাস ও আনন কেমিক্যাল।
মূলত পিকে হালদার রিলায়েন্স লিজিংয়ের এমডি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কৌশলে ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে সেখান থেকে অর্থ বের করে এ হোটেল ক্রয় করেন।
এ কাজে তাকে সহায়তা করেন আব্দুল আলিম। তার সহায়তায় পিকে হালদার দুবাইসহ অন্যান্য দেশে অর্থ পাচার করেছেন।
পিকে হালদার রিলায়েন্স লিজিং থেকে বিভিন্ন কায়দায় ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকা বের করেন।
পরে চাপে পড়ে গেলে একই কায়দায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বের করে রিলায়েন্সের দেনা পরিশোধের চেষ্টা করেন।
এ কাজে উজ্জ্বল নন্দী ছাড়াও নাহিদা রুনাই, আল মামুন সোহাগ, রাফসান রিয়াদ চৌধুরী, সৈয়দ আবেদ হাসানসহ ৪০-৪২ জনকে ব্যবহার করেছেন পিকে হালদার।
উজ্জ্বল নন্দী জবানবন্দিতে আরও বলেন, পিপলস লিজিং থেকে সাবেক পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ সাবেক পরিচালকরা বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন।
২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লিজ, ঋণ ও অ্যাডভান্স খাতে ফিন্যান্সিয়াল স্টেটম্যান্টে ১১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে।
ভুয়া ও অস্তিত্বহীন লিজ ফাইন্যান্সের মাধ্যমে ১৯১ কোটি টাকা গ্রহণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠন থেকে টার্ম লোন ২০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা কম দেখানো হয়েছিল।
আর্থিক বিবরণী থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল ২৫ কোটি টাকার ট্রেজারি লোন। কম দেখানো হয়েছিল কল লোন ও ওভার ট্রাফট ৭৪ কোটি টাকা।
সামসুল আলামিন রিয়েল স্টেটে পিপলস লিজিং থেকে ৫ কোটি ঋণ হিসাবে ট্রানজেকশন হলে এ ফাইলটি গায়েব করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পিপলস লিজিংয়ে কোনো ফাইল নেই, অথচ সামসুল আলামিন রিয়েল স্টেটে প্রসপেকটাসে এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
তিনি জানান, ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে ভাগবাঁটোয়ারা করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা।
ফলে এ সময় সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছিল ৩০৯ কোটি টাকা। দায় কম দেখানো হয়েছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এতে সম্পদ ও দায়ের পার্থক্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা।
এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, জিএমসহ পাঁচজনকে এক কোটি টাকা করে ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘুস দেওয়া হয়েছিল, যা ‘কিছু ভিআইপি ব্যক্তির জন্য মূল্যবান গিফট ক্রয় করা হয়েছিল’ মর্মে রেকর্ডপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেন, আমি ছাড়াও অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক ছিলাম। পরে এ কোম্পানির নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়।
পরে আমাকে নর্দান জুট মিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ইন্টারন্যাশনাল থেকে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের টাকা চলে যায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।
আমাকে আনান কেমিক্যাল লিমিটেডে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন পিকে হালদার। এ কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের অর্থ অমিতাভ অধিকারীর সহায়তায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন পিকে হালদার।
আনন কেমিক্যালের বর্তমান ঋণের দায় ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে ১১ কোটি ১৪ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়, যা দিয়ে দিয়া শিপিং লিমিটেডের নামে পরিচালিত ঋণ সমন্বয় করা হয়।
১৫ কোটি টাকা মেসার্স বর্ণ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, আরবি এন্টারপ্রাইজ হিসাবে এবং ৭ কোটি টাকা সুখাদা লিমিটেডের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। এসবই পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠান ছিল।
উজ্জ্বল নন্দী তার জবানবন্দিতে আরও বলেন, আমি রহমান কেমিক্যাল লিমিটেডের চেয়াম্যান হওয়ার আগেই অমিতাভ অধিকারী, স্বপন কুমার মিস্ত্রি রহমান কেমিক্যাল লিমিটেডের এমডি ও পরিচালক থাকা অবস্থায় ৫৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ঋণ নেন।
যার পুরো টাকাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১০টি চেকের মাধ্যমে বিভিন্ন তারিখে ঋণের অর্থে ৩৩ কোটি টাকা রহমান কেমিক্যালস লিমিটেডের নামে একটি ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
পরে সেখান থেকে পৃথক একটি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় পরিচালিত ‘পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল’-এর হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়।
অমিতাভ অধিকারী ও রাজীব সোমের পরিচালনাধীন কেএইচবি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের নামে পরিচালিত এক হিসাবে ৮ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়, যা আমি পরে জানতে পারি।
আমি নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের চেয়াম্যান থাকা অবস্থায় ৩০ কোটি টাকা ঋণ নিই। যার পুরো টাকাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কিছু ঋণের অর্থ দিয়ে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের তিনটি ঋণ হিসাব- ‘বর্ণ’-এর একটি ঋণ হিসাব এবং ‘আরবি এন্টারপ্রাইজ’-এর দুটি ঋণ হিসাবে সর্বমোট ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা সমন্বয় করা হয়।
এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণ নেওয়া হলেও এর পুরো অর্থ রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন পিকে হালদার।
পিকে হালদার প্রতিমাসে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা বেতন হিসাবে দিতেন। তিনি আমাকে ব্যবহার করে এভাবে ঋণ জালিয়াতি করবেন, তা তখন বুঝতে পারিনি।
উজ্জ্বল নন্দী তার জবানিতে আরও জানান, পিকে হালদার বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্ন দেশে প্রমোদের জন্য পাঠাতেন। আমি তিনবার মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম।
এর মধ্যে দুইবার পিকে হালদারের সঙ্গে। আমার সঙ্গে অমিতাভ অধিকারী, রাজীব সোমও মালয়েশিয়া গিয়েছিল। একবার ফ্যামিলি ট্যুরে গিয়েছিলাম। প্রতিবারই ভ্রমণের খরচ দিয়েছেন পিকে হালদার।
তিনি বলেন, পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাই। অবন্তিকা ও রুনাইয়ের মধ্যে ছিল পিকে হালদারকে নিয়ে চরম প্রতিযোগিতা।
তার বান্ধবী রুনাই চালাত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং অবন্তিকা পিপলস লিজিং। মূলত রুনাই আহমেদের অসীম ক্ষমতার উৎস ছিল পিকে হালদার।
তাই অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে রুনাই আহমেদ। কয়েক বছরে তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৭২ কোটি টাকার ট্রানজাকশন রয়েছে।
উজ্জ্বল নন্দী বলেন, আমি পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ৬৬ কাঠা জমি বিক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে অনিয়ম হয়েছে।
জমিটি পি অ্যান্ড হাল ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিক্রি করা হলেও পিপলস লিজিং থেকে জমির টাকা পরিশোধ হয়েছে কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল, হাল এন্টারপ্রাইজ, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, হাল ট্রাভেল ও এফএএস লিজিং থেকে। সবই পরোক্ষভাবে পিকে হালদারের কোম্পানি।
জমি বিক্রির ১২০ কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব টাকা আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিংয়ে স্থানান্তর হয়েছে।
সাবেক চেয়ারম্যান এ জমিটি বিক্রি বাবদ ৬ কোটি টাকা এবং চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার জন্য ১২ কোটি টাকাসহ ১৮ কোটি টাকা পিকে হালদারের কাছে ঘুস নিয়েছেন।
গ্রিনরোডস্থ ৭৩, গ্রিনরোডের ৬৬ কাঠা জমি ক্রয়ের জন্য অ্যাডভান্স হিসাবে পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ২০১০ সালের দিকে পিপলস লিজিং থেকে ১২৩ টাকা গ্রহণ করেন।
যার মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা দিয়ে পিপলস লিজিংয়ের ঋণ অ্যাডজাস্ট করেন। মূলত জমি ক্রয়ে দালালি করে এদের একজন ১২ কোটি টাকা এবং অপরজন ২৫ কোটি টাকা ঘুস গ্রহণ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনও উল্লেখ রয়েছে।
পিপলস লিজিংয়ে চেয়ারম্যান হওয়ার মতো যোগ্যতা প্রকৃত পক্ষে আমার ছিল না। পিকে হালদার আমাকে এ চেয়ারে বসিয়েছেন সবকিছু পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
আমাদের আগে চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে পিকে হালদার চেকের মাধ্যমে ১২ কোটি টাকা ঘুস দেন। এরপর তিনি রাজি হন এবং আমাকে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যানের চেয়ার পদ ছেড়ে দেন।
সূত্রঃ যুগান্তর