সরকারি ব্যাংকসহ প্রায় দুই ডজন ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদেরকে মুনাফা দিতে পারবে না
করোনাকালীন ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায় কার্যক্রমের ওপর শিথিলতা দেয়া হয়েছে। এতে বেড়ে গেছে ব্যাংকের কৃত্রিম মুনাফা। এ কৃত্রিম মুনাফার ওপর ভর করে ব্যাংকগুলো যেন বেশিমাত্রায় লভ্যাংশ বিতরণ করতে না পারে সে জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শর্তের বেড়াজালে আটকে দেয়া হয়েছে ব্যাংকিং খাতের ২০২০ সালের লভ্যাংশ বণ্টন। যেসব ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণের হার ১০ দশমিক ৬১ শতাংশের কম রয়েছে তারা শেয়ারহোল্ডারদের কোনো প্রকার লভ্যাংশ দিতে পারবে না। আর যারা এরই মধ্যে বাকিতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করছে তারা ৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মুনাফা বিতরণ করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। আর যারা বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণ করেনি, মূলধন সংরক্ষণের সক্ষমতা অনুযায়ী তারা সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নির্দেশনায় প্রায় সব সরকারি ব্যাংকসহ প্রায় দুই ডজন ব্যাংক মুনাফা দিতে পারবে না শেয়ারহোল্ডারদের বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অধিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বর্ধিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংকেরই প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে মুনাফা বণ্টন করতে অসুবিধা হচ্ছিল। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসায় ও ব্যাংকগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মুনাফা বণ্টনের সুযোগ দিতে বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া হয়; অর্থাৎ যেখানে কোনো ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি হলে ১০০ কোটি টাকাই প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাকিতে অর্থাৎ ১০০ কোটি টাকাকে ৫ ভাগ করে চার বছরের জন্য সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া হয়। ফলে ১০০ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ না করে ২০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ কর। প্রকৃত মুনাফা না হলেও বাকি ৭৫ কোটি টাকা মুনাফায় অন্তর্ভুক্ত করে, তা বণ্টন করা হয়। এভাবে ব্যাংকভেদে মূলধন তলানিতে নেমে গেছে। এতে কমে গেছে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিসহন ক্ষমতা।
এ দিকে করোনাভাইরাসের কারণে গত এক বছর ঋণ আদায় কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলে তাকে খেলাপি করা যাবে না। এর ফলে গত বছর ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় না করলেও সংশ্লিষ্ট ঋণকে খেলাপি করা যায়নি। আর খেলাপি না করায় সংশ্লিষ্ট ঋণ নিয়মিত থেকে যায়। নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ঋণ নিয়মিত হলে ওই ঋণের বিপরীতে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে না। এভাবেই ব্যাংকগুলোর নিয়ম অনুযায়ী কম প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর কম প্রভিশন সংরক্ষণ করায় বেড়ে যায় ব্যাংকগুলোর কৃত্রিম মুনাফা। এ কৃত্রিম মুনাফার ওপর ভর করে বাড়তি মুনাফা বণ্টন করতে না পারে সে জন্য ব্যাংকের মুনাফা বণ্টনের ক্ষেত্রে বাড়তি মূলধন সংরক্ষণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে মুনাফা বণ্টন করতে পারবে না।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এরই মধ্যে যেসব ব্যাংক বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণ করেনি তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ১৫ শতাংশের বেশি মূলধন সংরক্ষণ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদসহ ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে বিতরণ করতে পারবে। গেল বছর সমপরিমাণ মুনাফা বণ্টনের ক্ষেত্রে মূলধন সংরক্ষণ করতে হতো সাড়ে ১২ শতাংশের ওপরে।
আবার কোনো ব্যাংক সাড়ে ১৩ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে পারলে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশ নগদসহ ২৫ শতাংশ মূলধন লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে। একই সাথে যেসব ব্যাংক ১১ দশমিক ৮৭৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে তারা সাড়ে ৭ শতাংশ নগদসহ ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে। যেখানে আগের বছরে সমপরিমাণ মুনাফা বণ্টন করতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়েছে সোয়া ১১ শতাংশ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ।
তবে যেসব ব্যাংক এরই মধ্যে বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের সুযোগ নিয়েছে, তারা সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি মূলধন সংরক্ষণ করতে পারলে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের ১২ শতাংশ লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে। আর যেসব ব্যাংক এরই মধ্যে বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের সুবিধা নিয়েছে এবং তারা যদি ১১ দশমিক ৮৭৫ শতাংশ থেকে সোয়া ১২ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে পারে তা হলে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নগদসহ ১০ শতাংশ মুনাফা বণ্টন করতে পারবে। একই পরিমাণ মুনাফা বণ্টনের ক্ষেত্রে আগে সোয়া ১১ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়েছে।
একই সাথে যেসব ব্যাংক বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের সুবিধা নিয়েছে এবং তারা যদি ১০ দশমিক ৬২৫ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৮৭৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে পারে তা হলে তারা মাত্র ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ট বণ্টন করতে পারবে। আগে সমপরিমাণ মুনাফা বণ্টনের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়েছে।
এ নির্দেশনা ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ৪৫ ধারার ক্ষমতা বলে ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত বছরের জন্য ব্যাংকগুলোকে মুনাফা বণ্টনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।