প্রবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে অর্জিত অর্থ দেশে পাঠান, তাদের অনেকেই দেশে ফিরে স্বজনদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হন। ওই অর্থ যাদের কাছে পাঠানো হয়, তারা নানা কারণে টাকা খরচ করে ফেলেন, আবার অনেক প্রবাসীর পাঠানো অর্থে গড়া সম্পদ শেষ পর্যন্ত অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে বাধ্য হন।
যে মানুষদের জন্য তারা বিদেশে থেকে কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছেন, তারা সেগুলো খরচ করে ফেলছে। পরে বিদেশ থেকে ফিরলে তাদেরকে পরিবার আর গ্রহণ করতে চায় না। পুরুষদের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়। যে নারী এতো কষ্ট করে আয় পাঠাচ্ছেন, তার স্বামী হয়তো আরেকটা বিয়ে করে ফেলছে, অথবা সেই আয় তার নিজের নামেই নেই।
অন্যদিকে প্রবাসী পুরুষদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সব রোজগার স্ত্রীর নামে পাঠাতেন। স্ত্রী হয়তো সেই টাকা খরচ করে ফেলেছেন। এছাড়া কোন সম্পত্তি করার উদ্দেশ্যে বাবা-ভাইকে টাকা পাঠিয়েছেন, সেই সম্পত্তি তারা নিজেদের নামে নিবন্ধন করে নিয়েছে।
এমনও হয়েছে যে প্রবাসীর টাকায় হয়তো পরিবারের সম্পত্তি হয়েছে। কিন্তু প্রবাসীকে দেশে ফিরে এসে তা বাবা-ভাই-বোনদের সাথে ভাগ করে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এমনকি যে ভাইয়ের কাছে কাছে টাকা পাঠিয়েছেন, সেই ভাই নিজের নামে সম্পত্তি করে নিয়েছেন। অথবা স্ত্রীর নামে অর্থ পাঠিয়েছেন, তিনি হয়তো ভাই বা অন্য কারো সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে হারিয়েছেন। এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে।
ফল হয়েছে যে, জীবনের দীর্ঘ সময় প্রবাসে কাটিয়ে আজ খালি হাত, নিঃস্ব। ব্যবসা-বাণিজ্য করা তো দূরে থাক জীবন চালানোই তাদের জন্য কষ্ট।
এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেদের অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন প্রবাসীরা? এ সম্পর্কে অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে...
অন্তত দুইটি হিসাব খুলে বিদেশে যাওয়া
প্রত্যেক প্রবাসীর উচিত বিদেশে যাওয়ার আগে দুটি ব্যাংক হিসাব খুলে যাওয়া। তার একটিতে তিনি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অর্থ পাঠাবেন, আরেকটিতে থাকবে তার নিজের জন্য জমানো টাকা। এজন্য তারা ব্যাংকে নানা মেয়াদী সঞ্চয়ী স্কিম খুলে যেতে পারেন, যেখানে তাদের হিসাব থেকে সরাসরি টাকা জমা হবে।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, অনেক প্রবাসী কর্মী দেশে থাকা পিতা-মাতার নামে টাকা পাঠান। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীর কাছ থেকে অভিযোগ আসে যে তাকে ঠিকভাবে খরচ দেয়া হচ্ছে না।
এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পিতা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে আলাদা আলাদা হিসাব খুলে সেখানে টাকা পাঠানো যেতে পারে। তাহলে যেমন কোন জটিলতা থাকবে না, আবার নিজের টাকার ওপরেও তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
শুরু থেকেই সঞ্চয়ের পরিকল্পনা
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, অর্থ উপার্জনের জন্য বা চাকরি নিয়ে যখন কেউ বিদেশে যাচ্ছেন, তখন থেকেই তাকে পরিকল্পনা করতে হবে যে উপার্জিত অর্থ তিনি কীভাবে কাজে লাগাবেন। আপনি যখন বিদেশে যাচ্ছেন, যে টাকা পয়সা উপার্জন করছেন, আপনি ভাববেন না যে সেটা শুধুমাত্র আপনার পরিবারের বর্তমান খাওয়া-পরার অর্থ।
'আপনি যখন দেশে ফিরে আসবেন, তখন আপনার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেও টাকা প্রয়োজন হবে। তাই শুরু থেকেই আপনাকে সঞ্চয়ের ব্যাপারটি ঠিক করতে হবে। কীভাবে বিনিয়োগ করবেন, কোথায় বিনিয়োগ করবেন, তা ভাবতে হবে।
পারিবারিক বিনিয়োগ শুরু করতে পারেন
প্রবাসীদের নিজেদের নামে বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগের সুযোগ খানিকটা সীমিত। এর ফলে প্রবাসীরা জমি, বাড়ি ইত্যাদির পেছনে বেশি বিনিয়োগ করেন। তবে প্রবাসীরা তাদের পারিবারিক স্বজন বা স্ত্রীর মাধ্যমে বাড়ি-কেন্দ্রীক খামার বা ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারেন। যেমন- মুরগির খামার, মাছের চাষ ইত্যাদি ছোটখাটো ব্যবসাও করতে পারেন।
এর ফলে প্রবাসীর পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচ এই খাবার বা ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে কিছুটা হলেও মেটানো সম্ভব। এতে প্রবাসীর সঞ্চয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
জমি বা বাড়ির নিবন্ধনে নিজের নাম নিশ্চিত করা
অনেক সময় বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থে প্রবাসীর ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা নিজেদের নামে জমি বা বাড়ি রেজিস্ট্রি করে থাকেন। পরবর্তীতে প্রবাসীরা দেশে ফিরে মালিকানা জটিলতায় পড়েন। এক্ষেত্রে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ হচ্ছে, যে জমি বা বাড়ির পুরো টাকা পরিশোধের আগে অবশ্যই সেটি তার নিজের নামে হচ্ছে কি-না, সেটা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি তিনি বাংলাদেশে থাকার সময়ই এ ধরনের সম্পত্তির হস্তান্তর নিশ্চিত করা যায়।
দেশে পাঠানো টাকার খরচের হিসাব রাখুন
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে টাকা-পয়সা পাঠানো হয় অভিবাসীদের উচিত সেই টাকা কোথায়, কীভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে নিয়মিতভাবে খবর রাখা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেসব কাগজপত্রের ছবি দেখা এবং অনলাইনে যাচাই করে দেখা এখন খুবই সহজ ব্যাপার।
এর ফলে কোন স্বজন চাইলেও প্রবাসী অর্থ আয়কারীকে কোনরকম প্রতারণা করতে পারবে না বা ঠকাতে পারবে না।
সূত্র : বিবিসি বাংলা