করোনাভাইরাসের আঘাতে কমে এসেছে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। এর ফলে বছর জুড়েই ব্যাংকগুলোকে মহামারির চড়া মাশুল দিতে হয়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে থেকেই খেলাপি ঋণের চাপ, তারল্য সংকটের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি হওয়ায় পরিচালন মুনাফা কমেছে উল্লেখযোগ্যহারে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরের মত ২০২০ সালেও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করে ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে অবস্থান করছে । এর আগে ২০১৯ সালে ব্যাংকটি ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা করেছিল। তবে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলেছেন, গতকালও ব্যাংকের অনেক শাখা খোলা থাকায় হিসাব চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। পরিচালন মুনাফার অংক আরো বাড়তে পারে।
ব্যাংকাররা বলছেন, গত এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে (৯ শতাংশ) নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আর খেলাপি না হওয়া বা অশ্রেণিকৃত ভালো মানের ঋণে খাতভেদে সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয় দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বাইরে নতুন করে আরও এক শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে নিট মুনাফার ক্ষেত্রে চাপে পড়ছে ব্যাংকগুলো। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে।
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রান্তিক (তিন মাস) ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দেয়। তার আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভায় এ আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। পরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সে তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।
তবে নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে জমার দেয়ার আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানাতে পারবে না। তবে বিভিন্ন সূত্রে বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া যায়, যেখানে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে গেছে।
বিদায়ী বছরে পরিচালন মুনাফা ৭০০ কোটি টাকা কমেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের। তা সত্ত্বেও বরাবরের মতো এবারো পরিচালন মুনাফায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি খাতের এ ব্যাংক। ২০২০ সালে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
মুনাফায় বড় ধস হয়েছে আইএফআইসি, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, শাহজালাল ইসলামী, ওয়ান, সোস্যাল ইসলামী, ব্যাংক এশিয়া, সাউথইস্ট ও প্রাইম ব্যাংকের। এ ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। আর পরিচালন মুনাফা ১০ শতাংশের বেশি কমেছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, এনসিসি, যমুনা, আল-আরাফাহ্ ও ঢাকা ব্যাংকের। এছাড়া ডাচ্-বাংলা, পূবালী, এক্সিম ও ইস্টার্ন ব্যাংকেরও পরিচালন মুনাফা কমেছে। তবে দুর্যোগের মধ্যেও পরিচালন মুনাফা বেড়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, মধুমতি, ইউনিয়ন ও মেঘনা ব্যাংকের। এ ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহী বা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন ও কর-পরবর্তী এ মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। বছর শেষে ব্যাংকারদের দেয়া ইনসেনটিভ বোনাসও কিছু ব্যাংক পরিচালন মুনাফার মধ্যে হিসাবায়ন করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার ব্যাংকগুলো যে পরিচালন মুনাফা করেছে, সেটি প্রকৃত মুনাফা নয়। অনেক ব্যাংক অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে দেখানোয় পরিচালন মুনাফা কিছুটা ভদ্রস্ত দেখাচ্ছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতা থেকে বছরব্যাপী ছাড় পেয়েছেন গ্রাহকরা। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গ্রাহকদের বড় অংশই ঋণ পরিশোধ করেনি। নতুন বছরে খেলাপি ঋণের সময় গণনা শুরু হলে ব্যাংক খাত মন্দ ঋণের ভারে বিধ্বস্ত হবে। এছাড়া করোনাসৃষ্ট দুর্যোগকালের জন্য অশ্রেণীকৃতসহ ঋণের ১ শতাংশ অতিরিক্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিচালন মুনাফা থেকে অতিরিক্ত এ সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংকই লোকসানে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমার পেছনে প্রথম ধাক্কাটি ছিল ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা। করোনা মহামারী দ্বিতীয় ধাক্কা হিসেবে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় আঘাত করেছে। এক বছর ধরে গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপি হননি। অনেক গ্রাহকই সুযোগটি পুরোদমে কাজে লাগিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা সুখকর নয়।