করোনার বছরে ব্যাংকে আমানত রেখে বঞ্চিত হয়েছেন দেশের আমানতারীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং পুনঃতহবিলের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকিং খাতে টাকা সরবরাহ করায় আমানত চাহিদা কমে যায়। ঋণের সুদ এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তে ব্যাংকগুলো একসাথে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে। এতে ব্যাংকের গড় সুদহার বছরের শুরু থেকেই কমে যায়। একপর্যায়ে গড় মূল্যস্ফীতিরও নিচে নেমে যায় আমানতের মুনাফার হার, যা বছরের শেষ পর্যন্তও বহাল। বলা যায়, এতে সারা বছরই বঞ্চিত হয়েছেন আমানতকারীরা। কিন্তু যাদের জন্য আমানতকারীদের বঞ্চিত করা হয়েছে তারাও সুফল নেননি। করোনার কারণে ব্যাংকের বিনিয়োগ চাহিদা কমে গেছে। সারা বছরই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি মন্থর গতিতে চলে। এতে ব্যাংকিং খাতে এখন রেকর্ড উদ্বৃত্ত তহবিল সৃষ্টি হয়েছে। সবশেষ হিসাবে এ উদ্বৃত্ত তহবিলের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ চাহিদা বাড়ানোর জন্য বছরের শুরুতেই ঋণের সুদহার কমানোর জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ ছিল। এর আগের বছরে ৯/৬ ফর্মুলা দেয়া হয়। বলা হয়, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যাংকাররা সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নেয়। যেমন পরিচালকরা এক পরিবার থেকে দুইজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক থাকার দাবি আদায় করে নেন। পরিচালকের সময়সীমা বাড়িয়ে ৩ বছর করে দুই মেয়াদে ৬ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর করা হয়। বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমানো হয়। একই সাথে সরকারি আমানতের ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার দাবি আদায় করে নেয়া হয়। কিন্তু এর পরেও ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে না আনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলার জারি করে ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করে। এতে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য রাতারাতি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে। এর পর থেকে আমানতের সুদহার কমতেই থাকে। আর বাড়েনি। একপর্যায়ে ব্যাংক আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক রেটের নিচে নেমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম মাস অর্থাৎ জানুয়ারিতে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর ঋণের গড় সুদহার ছিল পৌনে ১০ শতাংশ। এর পর থেকেই আমানতের গড় সুদহার কমতে থাকে। ফেব্রুয়ারিতে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ, মার্চে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। এপ্রিলে তা ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশে নামিয়ে আনে। আর এই মাস থেকেই ঋণের গড় সুদহার ৯ দশমিক ৫৮ (মার্চে) শতাংশ থেকে কমে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে গড় সুদহার। যেমন, মে মাসে ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, জুনে তা কমে হয় ৫ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ এবং জুলাইয়ে ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। প্রথমবারের মতো আমানতের গড় সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নেমে গত আগস্টে আসে ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে হয় ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ, অক্টোবরে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ আর নভেম্বরে হয় ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। চলতি ডিসেম্বরে গড় আমানতের সুদহার এখনো চূড়ান্ত করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকাররা জানান, চলতি মাস শেষে তা সাড়ে ৪ শতাংশে নেমে যাবে।
আমানতের সুদহারই শুধু কমেনি, আমানতকারীদের ব্যাংকের নানা সার্ভিস চার্জ ও সরকারের ট্যাক্স পরিশোধ করতে গিয়ে প্রকৃত মুনাফা আরো কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত নভেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর নভেম্বরে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ আমানতকারীরা ব্যাংকে মুনাফা রেখে মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় বছর শেষে নিট মুনাফা না বেড়ে বরং ঋণাত্মক হয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে সারা বছরই আমানতকারীদের মুনাফা থেকে বঞ্চিত করা হলেও বড় কোনো সুফল ঘরে নিতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। গত এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার এক শতাংশে নামিয়ে আনার কারণে গড় ঋণের সুদহার পৌনে ১০ (জানুয়ারিতে) শতাংশ থেকে কমতে কমতে গত নভেম্বরে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। গত অক্টোবর শেষে তা ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। তবে ঋণের সুদহার ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ হিসেবে নিলে প্রকৃত বিনিয়োগ ১ শতাংশে নামে। কারণ, ব্যাংকে বিদ্যমান যে পরিমাণ ঋণ আছে তার সাথে ঋণের গড় সুদহার ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ যোগ করলে এমনিতেই বছর শেষে এ পরিমাণ ঋণ বেড়ে যাবে।
ব্যাংকাররা জানান, আমানতকারীদের বঞ্চিত করে বিনিয়োগকারীরা খুব লাভবান হননি। কারণ, করোনার প্রভাবে গত এপ্রিল থেকেই বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। কারণ, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে ঋণের চাহিদা কমে যায়। নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর বড় প্রমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ধস। গত অক্টোবরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ৪২ শতাংশ। প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা করোনার প্রাদুর্ভাবে বিদ্যমান শিল্পকারখানাই টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। বেশির ভাগ কারখানায় উৎপাদন ক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কাজে লাগানো যাচ্ছে। অনেকেই লোকসানের ধকল সামলাতে না পেরে শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এর ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো ঋণ নিয়ে কোম্পানির দায় বাড়াতে চাচ্ছেন না। ফলে ব্যাংকিং খাতে অলস অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানান, করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে; যা বাস্তবায়ন হচ্ছে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। ব্যাংকগুলোর তহবিল জোগানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫০ শতাংশ পুনঃঅর্থায়ন তহবিলে জোগান দেয়া হচ্ছে। এর বাইরেও ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে সহজ শর্তে ব্যাংকগুলোর তহবিলের জোগান দেয়া হচ্ছে। সবমিলে ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, ব্যাংকগুলোর হাতে এখন বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে স্বল্পসুদে বিনিয়োগ করছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নতুন বছরেও বিনিয়োগ চাহিদা বাড়বে না। ফলে আমানতের সুদহারে তেমন পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ নতুন বছরেও আমানতকারীদের জন্য তেমন কোনো সুখবর থাকছে না।