কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিভাগ হলো ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি। এ বিভাগটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা ছাড়া আর কেউ এ বিভাগের কোনো বিষয় পর্যবেক্ষণ কিংবা তথ্য পাওয়ার যোগ্য নন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা না পারলেও এতদিন তা পারতেন তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখা। কিন্তু এখন থেকে ব্যাংকগুলোর শাখা অফিসও সিআইবি তথ্য পরিদর্শন ও পরিবর্তন করতে পারবেন।
সম্প্রতি এমন একটি সিদ্ধান্ত দেশের সবগুলো ব্যাংককে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগটির দায়িত্ব এভাবে সব ব্যাংককে দেওয়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।
১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিভাগটির মূল দায়িত্ব ছিল দেশের ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ব্যাংক তথা সাধারণ জনগণের আমানত সুরক্ষিত রাখা। সেই লক্ষ্যে সিআইবি ডিপার্টমেন্ট তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে দেশের যে কোনো ঋণগ্রহীতার তথ্য জানতে পারতো অন্যান্য ব্যাংকগুলোও। এর ফলে কোনো ঋণ খেলাপি অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পরবর্তীতে ঋণ পেত না।
এ অবস্থায় তথ্যের অপব্যবহারের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কোন বিবেচনায় এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য পাঠাতো। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তথ্য পরিবর্তন ও অনুমোদন করতো। কিন্তু এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে না জানিয়েই তথ্য পরিবর্তন ও অনুমোদন করতে পারবে দেশের সবগুলো তফসিলি ব্যাংক।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শাখাগুলোও সিআইবিতে প্রবেশ এবং তথ্য পরিবর্তনের অনুমোদন পেয়েছে। বর্তমানে দেশে ১১ হাজার ২২৭টি শাখা রয়েছে তফসিলি ব্যাংকগুলোর। শাখাগুলো চাইলেই সিআইবিতে প্রবেশের অধিকার পাবে। পারবে যে কোনো তথ্য পরিবর্তনেরও। এজন্য লাগবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমতি।
শাখাগুলো চাইলে দুই বা ততোধিক কিংবা শাখার প্রয়োজন অনুযায়ী সিআইবি অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবে। এর জন্য দিতে হবে না কোনো টাকা। এর আগে ব্যাংকের প্রধান শাখাগুলো দুটির বেশি সিআইবি অ্যাকাউন্ট চালাতে পারতেন না। এর বেশি অ্যাকাউন্ট করতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দিষ্ট একটি অংকের ফি বা চার্জ প্রদান করতে হতো। এখন থেকে তাও লাগছে না শাখাগুলোর। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সিআইবির কার্যক্রম চালাতে পারবে প্রতিটি শাখা।
এ বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতাকে অন্যের কাছে হস্তান্তরের সঙ্গে তুলনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শাখাগুলোর কাছে সিআইবির প্রবেশাধিকার ও পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়ায় হয়তো কিছুটা উপকার হতে পারে। কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব কোনো অ্যাসেসমেন্ট থাকতে পারে। কিন্তু ওভারঅল এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য হিতে বিপরীত হবে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা পরবর্তীতে আরো বাজে ফলাফল বয়ে এনেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত আরো সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে নিলে ভালো হতো বলে মনে করি। তবে, এ সিদ্ধান্ত ভালো কোনো ফল আনবে না, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইটি) বিভাগের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সিআইবি এন্ট্রি এবং আপডেটের অধিকার পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আইটি বিভাগের নিজস্ব সফটওয়্যারে এখন থেকে তথ্য প্রদান করবে শাখাগুলো। এবং এগুলো প্রত্যয়ন করবে প্রতিটি ব্যাংকের প্রধান শাখা। যদি কোনো ভুল তথ্য কিংবা অনৈতিক কোনো কাজ করতে চায় তবে তার দায় নিবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ সফটওয়্যার পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এসব কর্মকর্তা তাদের অধীনস্ত সব কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেবেন বলেও জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অনেক ব্যাংকাররা বলছেন, আমার আসলে জানা নেই কেন এমন একটি সিদ্ধান্ত ঠিক জাতীয় নির্বাচনের আগে নেওয়া হলো। এতে করে সমস্ত প্রেশার (রাজনৈতিক চাপ) আমাদের ওপরে আসবে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে এ সিদ্ধান্ত থাকার ফলে আমরা সংশ্লিষ্ট গ্রাহক বা প্রভাবশালী কোনো গ্রাহককে বলতে পারতাম যে এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। আমাদের করার কিছু নেই। কিন্তু এখন আমরা আর তা বলতে পারবো না। যার ফলে তারা আমাদেরকে প্রেশার দিবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রেশার তো সবাই দিতে পারে না। ওই পরিমাণ ক্যালিবার দেশের ১ শতাংশ লোকের আছে সর্বোচ্চ। কিন্তু আমাদেরকে প্রেশার দেওয়ার মতো লোক দেশে অনেক আছে। পাশাপাশি আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাখাগুলোকে যদি একদম চতুর্থ বা পঞ্চম সারির রাজনৈতিক নেতাও চাপ দেয় তথ্য পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনের তাও শাখা ম্যানেজার পালন করতে বাধ্য হবেন। এর ফলে সেই নেতা বা ব্যক্তি অনৈতিক সুবিধা নেবেন। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং শাখা কর্মকর্তাকে দায়ী করে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এর পেছনের অবস্থা খতিয়ে দেখবে না।’
এ সিদ্ধান্তটি কীভাবে খারাপ ফল আনতে পারে জানতে চাইলে ২৮ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এ ব্যাংকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ধরা যাক কোনো একজন ঋণ খেলাপি একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চায় নতুন করে। কিন্তু সিআইবি রিপোর্টের কারণে অন্য ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। এমন কাউকে ঋণ দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও শাস্তি দিবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে। এখন থেকে কেউ এমন করতে চাইলে যে ব্যাংকে ঋণ আছে সে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় গিয়ে চাপ দিবে সিআইবি ক্লিয়ার করে দেওয়ার জন্য। সে ব্যাংক ম্যানেজার বা কর্মকর্তাকে যতভাবে সম্ভব ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে কিংবা অনৈতিক প্রস্তাব অথবা রাজনৈতিক চাপ দিয়ে কাজ আদায় করে নিবে। এ কাজটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে করা এত সহজ হতো না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এমন একটি সিদ্ধান্ত ঠিক নির্বাচনের আগে কেন নিতে হলো তা বোধগম্য না। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন ছিল। তবে এ সিদ্ধান্তে যে সমস্যাটা হবে তা হলো লোকাল শাখাগুলো প্রেশার হ্যান্ডেল করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও শাখাগুলো থেকে পাওয়া ভুল তথ্যগুলো তাৎক্ষণিক ভেরিফাই করতে পারবে না। যার ফলে উদ্দেশ্য সাধণ হয়ে যাওয়ার পরে ব্যাংকারকে শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। আমার মনে হয় এর বড় কারণ নির্বাচন কেন্দ্রীক। নির্বাচনে কেউ যেন ঋণ খেলাপি হিসেবে মনোনয়ন না হারায় সে কারণে এটাকে ব্যবহার করা হবে।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়টিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো সক্রিয় হতে হবে। ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখা আগে করতে পারতো। এখন দ্রুত করতে রিজিওনাল হেড অফিসগুলোকে দিতে পারতো শাখা অফিসগুলোকে দায়িত্ব না দিয়ে। এছাড়া ব্যাংকারদেরকে খুবই তীক্ষèভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। নইলে এর সুফল পাওয়া যাবে না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের ভালো দিক আছে, খারাপ দিকও আছে। ভালো দিক হলো এখন থেকে খেলাপি ঋণের তথ্য তাৎক্ষণিক পাওয়া যাবে। কে খেলাপি হলো, কত টাকা হলো তা জানা যাবে। অন্যান্য ব্যাংকও গ্রাহকের ক্রেডিট রেটিং দেখতে পারবে। তাতে করে ঋণ প্রদানে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। তবে খারাপ দিক হলো, এ সিদ্ধান্তের কোয়ালিটি কন্ট্রোল না করতে পারলে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে দেশের ব্যাংকিং খাতে। এজন্য এর কন্ট্রোলিং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে নিশ্চিত করতে হবে শাখা অফিস কিংবা ব্যাংকের হেড অফিস যেন সময়মতো তথ্য প্রদান করে। এবং একই সাথে তথ্য যেন সঠিক হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যদি ভুল তথ্য প্রদান করে বা কোনো গ্রাহককে বিশেষ সুবিধা দেয় তবে ন্যূনতম ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে অপরাধের মাত্রা বুঝে সর্বোচ্চ জরিমানা এবং শাস্তির বিধান রাখতে হবে।’
ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) রিপোর্টের ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার সঙ্গে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
তিনি বলেন, ‘এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কাজের অংশ। তারই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ছিল এটি। তবে ব্যাংকগুলোর শাখা পর্যায় থেকে সিআইবির তথ্য পরিবর্তন করার যে খবর প্রচার হচ্ছে, তা সঠিক নয়।’
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আইসিটি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায়।
সংবাদ সম্মেলনে দেবদুলাল রায় বলেন, ‘সিআইবি সংক্রান্ত রিপোর্ট সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা কোনো বিড়ম্বনা তৈরি করবে না। বরং এটি তথ্য হালনাগাদ প্রক্রিয়া সহজ করবে এবং দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।’
তিনি বলেন, ‘আগে ব্যাংকে তিন থেকে চারটি ইউজার আইডি দেওয়া হতো। এখন সেটি বাড়ানো হয়েছে, একাধিক ইউজার হবে। এর বাইরে নতুন কিছুই করা হয়নি।’
এসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ব্যাংকের শাখা পর্যায় থেকে তথ্য হালনাগাদ করার বিষয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা নিরসনেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। শাখা থেকে তথ্য হালনাগাদ করলেই সিআইবি তথ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে না। এর জন্য আলাদা অনুমোদনকারী কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন। তাই চাইলে যে কেউ সিআইবির তথ্য পরিবর্তন করতে পারবেন- এই ধারণা সঠিক নয়।’
তিনি বলেন, ‘আগে সিআইবি রিপোর্ট পরিবর্তন করতে বা কোনো সংশোধনী থাকলে তা সম্পূর্ণ করতে এক মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেত। গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ভুল হলেও সেটা সংশোধন করতে হতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। নতুন সিদ্ধান্তের কারণে শাখা পর্যায় থেকেই কর্মকর্তারা নিজেদের তথ্য হালনাগাদ করে পাঠাতে পারবেন। কেউ যদি ভুল তথ্য দিয়ে সিআইবি রিপোর্ট ভালো করার চেষ্টা করেন, সেই ভুল তথ্য সফটওয়্যার সাপোর্ট করবে না।’