ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের দখলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, মোট এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ৫০ হাজার টাকাই রয়েছে এই পাঁচ ব্যাংকের দখলে। বাকি ৫৬ ব্যাংকের দখলে রয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। আর শীর্ষ ১০ ব্যাংকের দখলে রয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৬২ শতাংশ।
গতকাল সোমবার রাতে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ প্রতিবেদন প্রতি তিন মাস অন্তর প্রকাশ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন দিয়ে ব্যাংকিং খাতের আর্থিক ঝুঁকির চিত্র তুলে ধরা হয়। তবে এতে কোনো ব্যাংকের নাম দেয়া হয় না। ব্যাংকগুলোর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের বেশি হলেই তা ঝুঁকির আওতায় আনা হয়। আর এটা বিবেচনায় নিলে আলোচ্য ব্যাংকগুলোর ঋণঝুঁকির মাত্রায় চলে গেছে। বিশেষ করে গত দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমে গেছে। দুই বছর যাবৎ কোনো খেলাপি ঋণ আদায় করা হয় না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রীতি অনুযায়ী দুই বছর খেলাপি ঋণ আদায় না হলেই এমন ঋণকে অনাদায়ী ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এসব ঋণ আদায়ের জন্য আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, এমন অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৮৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ থাকায় শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের বেশি ঝুঁকি রয়েছে। একই সাথে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের ঝুঁকিও কম নয়। তবে শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের চেয়ে কম। খেলাপি ঋণের কারণে এসব ব্যাংকগুলোর মোটা অঙ্কের অর্থ প্রভিশন খাতে আটকে রয়েছে। এর বিপরীতে মূলধন ঘাটতিও রয়েছে। সব মিলে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাপি ঋণ যেমন শীর্ষ ১০ ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি, তেমনি সম্পদের দিক থেকেও অন্য ১০টি ব্যাংক এগিয়ে রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদের ৪৭ শতাংশ সম্পদই রয়েছে ১০ ব্যাংকের হাতে। বাকি ৫১ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৫৪ শতাংশ সম্পদ। শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৩২ শতাংশ সম্পদ। বাকি ৫৬ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৬৮ শতাংশ সম্পদ। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুষম প্রতিযোগিতা না থাকার কারণে সম্পদ আহরণেও বৈষম্য রয়েছে। ব্যাংকগুলোর সম্পদ বলতে ঋণকে বুঝায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ব্যাংকের সংখ্যা ৭টি। ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে পাঁচটি ব্যাংকের। ১০ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে তিনটি ব্যাংকের। ৫ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ১০টি ব্যাংকের। ৩ শতাংশের বেশি থেকে ৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ১৯টি ব্যাংকের। ২ শতাংশের বেশি থেকে ৩ শতাংশের কম খেলাপি রয়েছে ৮টি ব্যাংকের। ২ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ৯টি ব্যাংকের। ২ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও আমানত বাড়লেও মূলধন কমেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে মূলধন ছিল ৯ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা কম হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা মূলধন কমেছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বাড়ার কারণে ব্যাংকিং খাতে মূলধন কমেছে।
শুধু ব্যাংকিং খাতেরই খেলাপি ঋণ বাড়েনি, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণও বেড়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। ওই সময়ে মোট খেলাপি ঋণের হার ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ।