আমানতের সুদহার বাড়ানোর চেষ্টায় গত আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে টাকা তুলছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রাবাজারে উদ্বৃত্ত অর্থ কমিয়ে টাকার টান তৈরির জন্য এটি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগের ফলে আন্তঃব্যাংক কলমানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদহার অনেক বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপাতত টাকা না তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
বাজারে অতিরিক্ত তারল্য ব্যবস্থাপনায় রেপো ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে রেপোতে নির্ধারিত ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। এ উপায়ে উঠানো অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই পড়ে থাকে। যে কারণে রেপোর পাশাপাশি ৭, ১৪ ও ৩০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে টাকা তোলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। বাজারে প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থ থাকায় গত আগস্ট থেকে আবার নিলাম শুরু হয়। এই নিলামের কারণে আন্তঃব্যাংকে অস্বাভাবিকভাবে কমে আসা সুদহার বাড়তির দিকে রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে ডিসেম্বরের জন্য প্রকাশিত নিলাম ক্যালেন্ডারে এ উপায়ে টাকা তোলার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে কবে, কী পরিমাণ টাকা তোলা হবে, সাধারণত মাস শুরুর আগেই তার ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হয়। গত সোমবার চলতি ডিসেম্বর মাসের নিলামের ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ক্যালেন্ডারে ৭ ও ৩০ দিন মেয়াদি বিলের ঘরই রাখা হয়নি। আর ১৪ দিন মেয়াদি বিলের ঘর থাকলেও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। ফলে ব্যাংকাররা ধারণা করছেন, চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে কোনো টাকা তুলবে না। বিলের মাধ্যমে টাকা না তুললে সুদহার আবার পড়ে যাবে। তাতে করে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সুবিধা হলেও উদ্বৃত্তে থাকা ব্যাংক সমস্যায় পড়বে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কিছু ব্যাংকের হাতে বাড়তি টাকা থাকলেও কয়েকটি ব্যাংক সংকটে রয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তোলায় সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়ছে। এ রকম প্রেক্ষাপটে আপাতত কয়েকদিন টাকা তোলা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বিল-বন্ডে বিনিয়োগের অনেক অর্থে এ মাসে মেয়াদপূর্তি রয়েছে। ফলে একদিনও বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম হবে না, সেটা এখনই বলা যাবে না।
সংশ্নিষ্টরা জানান, করোনার কারণে ঋণ চাহিদা কমায় এর আগে অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের নানাভাবে নিরুৎসাহিত করছিল। কোনো কোনো ব্যাংক মেয়াদি আমানতে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে গত আগস্টে এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ের তিন মাস মেয়াদি আমানতে কোনো ব্যাংক যেন গড় মূল্যস্ম্ফীতির কম সুদ দিতে না পারে, সে নির্দেশনা দিয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এরপর আন্তঃব্যাংকে সুদহার বাড়তির দিকে উঠছিল। আন্তঃব্যাংক কলমানিতে গত আগস্ট মাসের শুরুতে ২ শতাংশের নিচে নেমে আসা সুদহার বেড়ে গত ১৮ নভেম্বর সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে ওঠে। তবে ওইদিন সাত দিন মেয়াদি বিলের নিলাম ডাকা হলেও শেষ পর্যন্ত বাজার থেকে কোনো টাকা তোলা হয়নি। যদিও আটটি ব্যাংক নিলামে অংশ নিয়ে ৯১৭ কোটি টাকা খাটানোর আবেদন করেছিল। ওইদিন টাকা না তোলার পর থেকে কলমানিতে প্রতিদিন সুদহার একটু করে কমে ২৯ নভেম্বর ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে বাজারে প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজারে প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত আছে। তবে ৯ আগস্ট থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা তোলার পর মুদ্রাবাজারে নগদ টাকার টান তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে সংকটে থাকা অনেক বিলের নিলাম না করতে নানাভাবে উৎসাহিত করে আসছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও চূড়ান্তভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি বিলের দু'দিন করে নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর ৩০ দিন মেয়াদি বিলে আগস্টে তিন দিন, বাকি তিন মাসে দু'দিন করে নিলাম হয়। এর মধ্যে গত ১৮ নভেম্বরের সাত দিন মেয়াদি বিলের নিলামে কোনো টাকা তোলা হয়নি। সব মিলিয়ে গত আগস্টে ১৯ হাজার ৬৪৫ কোটি, সেপ্টেম্বরে ১৯ হাজার ২২৪ কোটি, অক্টোবরে ১৯ হাজার ২৮৫ কোটি এবং নভেম্বরে ১০ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা তোলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আমদানি ব্যাপক বাড়লেও রেমিট্যান্স কমায় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। আমদানি দায় মেটাতে কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। গত ১৯ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।