খেলাপি ঋণের চাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে দেশের ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণের উচ্চহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য খেলাপির হার পাঁচ শতাংশ। বর্তমানে দেশের ৪০টি ব্যাংকের খেলাপির হার এ সীমার ওপরে চলে গেছে।
হালনাগাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মাত্র ১৮ ব্যাংক নির্ধারিত খেলাপির মাত্রায় রয়েছে। এছাড়া শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে মূলধন সংকটে পড়বে দেশের পুরো ব্যাংক খাত। এতে ব্যাংকের মুনাফা কমে আসবে। খেলাপি ঋণ কমানোর প্রধান উপায় আদায় কার্যক্রম জোরদার করা।
গত এপ্রিল-জুন ২০২১ প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রভাব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খেলাপি ঋণের উচ্চহার কমাতে ভালো মানের ঋণ বিতরণ বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। ব্যাংকগুলোকে সতর্কভাবে ঋণ দিতে হবে। জালিয়াতি বন্ধ এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারলে খেলাপি কমানো যাবে না।’
জানা গেছে, পূর্ববর্তী প্রান্তিকের চেয়ে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে নতুন খেলাপি ঋণ বেড়েছে। কিন্তু কভিডকালের বিশেষ ছাড় সুবিধায় খেলাপি ঋণের হার কিছুটা কমেছে কাগুজে হিসাবে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক মন্তব্য করেছে, উচ্চহারের খেলাপির ফলে ব্যাংকের মুনাফা ও মূলধন পর্যাপ্ততার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। খেলাপি ঋণ আদায় প্রধান উপায়। যদিও এতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় বলে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ খেলাপিকে আন্তর্জাতিক হিসেবে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। খেলাপি হারের এ মানদণ্ড ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং দেয়। এ সীমার অতিরিক্ত করলে ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং মান কমতে থাকে।
জানা গেছে, ব্যাংক খাতের মোট সম্পদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৮০ শতাংশ ঋণও আগাম খাতে। বিনিয়োগ খাতে রয়েছে ১৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ। স্থায়ী সম্পদে এক দশমিক চার শতাংশ ও অন্যান্য খাতের সম্পদ হচ্ছে চার দশমিক সাত শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট সম্পদের মধ্যে ঋণ ও বিনিয়োগ খাতে সর্বোচ্চ রয়েছে। এরপর রয়েছে অন্যান্য খাত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে খেলাপির হার পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে মাত্র ১৮টি ব্যাংকের। এর মধ্যে দুই শতাংশ খেলাপি হচ্ছে মাত্র সাতটির। আগের প্রান্তিকে এ সংখ্যা ছিল ৯টি। খেলাপির হার পাঁচ শতাংশের ওপর, কিন্তু ১০ শতাংশের নিচে থাকা ব্যাংক হচ্ছে ১০টি। আবার ১০ শতাংশের ওপর কিন্তু ১৫ শতাংশের নিচে রয়েছে চারটি, ১৫ থেকে শতাংশের ঘরে রয়েছে তিনটি ও ২০ শতাংশের ওপর রয়েছে আটটি ব্যাংক।
খেলাপি ঋণের বিপরীতে নতুন করে ছয় হাজার ১৫০ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখা প্রয়োজন। অপরদিকে একই সময় সংরক্ষিত প্রভিশন বৃদ্ধি পায় মাত্র ৬৯০ কোটি টাকা। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ দশমিক ৮৯ শতাংশ, জুন পূর্বের প্রান্তিকে যা ছিল ৬২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জুন শেষে খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৮ দশমিক ৯০ শতাংশ আদায় অযোগ্য বা মন্দ মানের ঋণ। এ মন্দ ঋণ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে ধরে নেন ব্যাংকাররা।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক মন্তব্য করেছে, ব্যাংকের মুনাফা বাড়াতে হলে ভালো গ্রাহককে ঋণ দিতে হবে। ঋণের গুণগতমান বাড়াতে হবে। ব্যাংকের পণ্য তথা ঋণ দিতে নতুন খাত বের করার উদ্যোগে নিতে হবে। ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধাগুলো গ্রাহকবান্ধব ও তুলনামূলকভাবে কম খরচে দিতে হবে। এতেই গ্রাহক সন্তুষ্টি বাড়বে। খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও তার তদারকি বাড়িয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের আট দশমিক ৬১ শতাংশ। কিন্তু অবলোপন ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণের হিসাবে যোগ করলে দেশের প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বলে প্রতিবেদন দিয়েছিল আইএমএফ। গত জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
জুনের আগের প্রান্তিকে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি হওয়ার ঋণের সিংহভাগ জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা। পরিশোধের সময় আর শোধ হচ্ছে না। ফলে খেলাপি হচ্ছে। এজন্য ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি আরও কঠোরভাবে করতে হবে। কারণ ব্যাংকের আমানত জনগণের অর্থ। একে রক্ষা করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের।