রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ‘ফোর্সড লোন’ (বাধ্যতামূলক ঋণ) বেড়েই চলেছে। সরকারি খাতের চার বাণিজ্যিক ব্যাংকে জুন পর্যন্ত ফোর্সড লোনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় হাজার ২২২ কোটি টাকা। এসব লোন সৃষ্টিতে অধিকাংশ সময়ই নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই চার প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণও বাড়ছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের মূল সমস্যা খেলাপি ঋণ। এর ঊর্ধ্বগতি কমাতে হলে ঋণের মান বাড়াতে হবে, সতর্কভাবে ঋণ দিতে হবে। ফোর্সড লোন কমাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এলসি গ্যারান্টি নেওয়ার সময় তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাইয়েরও পরামর্শ দেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় ওই চার ব্যাংকের ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দ্রুত খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা এড়াতে যাচাই-বাছাই করে ঋণ বিতরণের পরামর্শ দেওয়া হয় সভায়। প্রতি তিন মাস পরপর এমওইউ’র অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকে জুন পর্যন্ত ফোর্সড লোনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় হাজার ২২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে ছয় মাসে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে ফোর্সড লোন বেড়েছে ৩০৯ কোটি। আলোচিত সময়ে রূপালী ব্যাংকে ফোর্সড লোন কমেছে ৭৫ কোটি টাকা।
বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ফোর্সড লোনের পরিমাণ দুই হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৭২২ কোটি টাকা ছিল। হিসাব বলছে, গত ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির ফোর্সড লোন বেড়েছে ছয় কোটি টাকা। একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ফোর্সড লোন বেড়েছে ২৬৭ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের বেড়েছে ৩৬ কোটি টাকা।
সরকারি চার ব্যাংকের মধ্যে ব্যতিক্রম রয়েছে রূপালী ব্যাংক। জানুয়ারি থেকে জুন (৬ মাস) পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকেরই ফোর্সড লোনের পরিমাণ কমেছে। এ খাত থেকে আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর কারণে সার্বিকভাবে ফোর্সড লোনের পরিমাণ কমেছে। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের ফোর্সড লোন ৯১৫ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৯৯০ কোটি টাকা। হিসাব মতে, গত ছয় মাসে ব্যাংকটির ফোর্সড লোন কমেছে ৭৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এলসি গ্যারান্টি নেওয়ার সময় অধিকাংশ ব্যাংক সঠিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে যাচাই-বাছাই করে না। এ কারণে ফোর্সড লোন বাড়ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে অ্যাসেসমেন্ট সঠিক না হলে এ ঋণ বাড়তেই থাকবে।
প্রসঙ্গত, পণ্য আমদানির (এলসি) বিপরীতে বিদেশি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়ে থাকে দেশি ব্যাংকগুলো। আমদানি করা পণ্য দেশে আসার পর শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করলে ওই অর্থ বিদেশি ব্যাংককে সংশ্লিষ্ট দেশি ব্যাংক পরিশোধ করে। তবে গ্রাহক অর্থ পরিশোধ না করলে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী সেই গ্রাহকের নামে ব্যাংক ফোর্সড বা বাধ্যতামূলকভাবে সমপরিমাণ ঋণ সৃষ্টি করে। ওই অর্থে দেশি ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করে। এভাবে ব্যাংকে গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন হয়, যা মূলত আমদানির বিপরীতেই ‘সৃষ্টি হয়’।
নির্দিষ্ট শাখায় ঋণ বিতরণ
গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। এসব ঘটনার অধিকাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হয়েছে। যেসব- শাখার মাধ্যমে ঋণ জালিয়াতি হয়েছে, সেসব শাখার মাধ্যমেই সিংহভাগ ঋণ বিতরণ হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের (২০২১) জুন শেষে মোট ৬৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে ৪৫ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে মাত্র পাঁচটি শাখা থেকে, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭২ শতাংশ। জনতার মতো পাঁচ শাখার মাধ্যমে অধিকাংশ ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে আরও তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক।
চলতি বছরের জুন শেষে রূপালী ব্যাংক ৩৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। যার মধ্যে মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৬১ শতাংশ। পাঁচ শাখার মাধ্যমে ৪৭ শতাংশ ঋণ ছাড় করা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংক থেকেও। মোট ৫৪ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক ৬০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এর মধ্যে নির্দিষ্ট পাঁচ শাখার মাধ্যমে ব্যাংকটি থেকে বিতরণ হয়েছে ১৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ। এ ব্যাংকটির মোট শাখা সংখ্যা এক হাজার ২২৮টি।
অনুষ্ঠিত অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদানে ব্যাংক যত বেশি আগ্রহী আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি তত আগ্রহী নয়। এ থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চল নির্বিশেষে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ কয়েকটি শাখায় পুঞ্জীভূত হওয়া নিয়ে সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা ব্যাংকিংখাতের জন্য দুঃখজনক। এতে অনেক উদ্যোক্তা ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর ঋণ গুটিকয়েক শাখায় পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে ভবিষ্যতে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এছাড়া নতুন করে লোন দেওয়ার আগে সার্বিক পর্যালোচনা করতে হবে।