নানা কারণে আলোচিত পদ্মা ব্যাংক সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার যে প্রস্তাব সরকারকে দিয়েছিল, তাতে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
তার বদলে পদ্মা ব্যাংক বিদেশ থেকে বিনিয়োগ এনে মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে পারলে সেটাই ভালো হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরামর্শ দিয়েছে, খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে গত মঙ্গলবার এই মতামত জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা তাদের বলেছি যে যেহেতু তারা বাইরে থেকে বিনিয়োগ পাচ্ছে। বাইরে থেকে বিনিয়োগ নিয়ে এলে আমরা তাদের অনুমতি দিয়ে দেব। আমরা তাদের বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনার প্রস্তাবে রাজি হয়েছি।”
পদ্মা ব্যাংকের আগে নাম ছিল ফারমার্স ব্যাংক। অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে লিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে।
সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পরের বছর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।
সে সময় পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক, যা ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।
কিন্তু টাকার অভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হিমশিম খাওয়া পদ্মা ব্যাংক গত জুলাই মাসে সরকারের কাছে নতুন আবেদন করে।
সেখানে সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার অনুমতি চায় পদ্মা ব্যাংক। আর তা না হলে সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় ওই আবেদনে।
পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এহসান খসরুর পাঠানো ওই প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিল।
এর মধ্যেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “ব্যাংক যেগুলো মার্জার করা দরকার, সেগুলো মার্জার হবে। সেটার আইন (ব্যাংক কোম্পানি) ড্রাফট হয়ে গেছে। আমরা এগুলোকে সংসদে নিয়ে আসব। সেখান থেকে অনুমোদিত হয়ে যাওয়ার পর মার্জার কার্যক্রম শুরু হবে।”
কিন্তু ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে যে চিঠি দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, পদ্মা ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাথে ‘সমঞ্জস্যপূর্ণ নয়’।
আর সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার যে প্রস্তাব পদ্মা ব্যাংক দিয়েছিল, তাতেও সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকারের অনুমোদন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে একীভূতকরণের সুযোগ বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে আছে। দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংককে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ বা অবসায়নের ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে নিশ্চিত হতে হয় যে, একীভূত হলে তা তাদের পাওনাদার, শেয়ারহোল্ডার বা আমানতকারীরা সমানভাবে লাভবান হবে।
সেজন্য পক্ষগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রত্যয়ন নিয়ে হাই কোর্টে আবেদন করতে হবে। সেখানে বলতে হবে, একীভূত হলে তা পাওনাদার, শেয়ারহোল্ডার বা আমানতকারীদের ক্ষতির কারণ হবে না।
হাই কোর্টে আবেদন করতে হলে সেই ব্যাংক এবং একীভূত করে নিতে রাজি হওয়া অন্য ব্যাংকের দায় এবং সম্পদের মূল্য ও প্রকৃত অবস্থা নিরূপণে বিশেষ নিরীক্ষা করতে হবে।
এসব নিয়ম তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, “তাছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলো নিজেরাই অধিক মাত্রায় খেলাপী ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও অন্যান্য আর্থিক সূচকসহ, ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে রয়েছে।”
পদ্মা ব্যাংকের দুই প্রস্তাব নাকচ করে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ওই প্রস্তাব দেওয়ার আগেই পদ্মা ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ডেলমর্গান অ্যান্ড কোম্পানির কাছে মূলধন চেয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২ অগাস্ট এ ব্যাপারে নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছে।
“বর্ণিত প্রেক্ষাপটে এ পর্যায়ে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে পদ্মা ব্যাংক কর্তৃক বৈদেশিক মূলধন আনা সম্ভব হলে তা করাই শ্রেয় হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ বলেন, “পদ্মা ব্যাংকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। যেহেতু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি তাই চিঠির বিষয়ে কিছু বলারও পরিস্থিতি হয়নি। চিঠির বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।”
কী চেয়েছিল পদ্মা ব্যাংক?
যাত্রা শুরুর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক দেউলিয়া হতে বসেছিল ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এ ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়, পুনর্গঠন করা হয় পরিচালনা পর্ষদ। ব্যাংকের নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক।
সরকারের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলে পদ্মা ব্যাংকের মালিকানার বেশিরভাগ অংশ কিনে নেয়। সেজন্য ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন যোগাতে হয়।
কিন্তু তাতেও যে পদ্মা ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকের এমডি এহসান খসরুর লেখা চিঠিতেই তা স্পষ্ট ছিল।
সেখানে বলা হয়েছিল, সরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ৭১৫ কোটি টাকার মুলধন দিয়ে পদ্মা ব্যাংক ‘ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা’ করছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ব্যাংক খাত ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়’ তারা মূলধন সঙ্কটে পড়েছে।
এহসান খসরু সেই চিঠিতে বলেছিলেন, পদ্মা ব্যাংক বর্তমানে যে আয় করছে, তার চেয়ে ব্যায় বেশি হচ্ছে।
২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাব তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, ৫ হাজার ৬২২ কোটি টাকার সম্পদের বিপরীতে পদ্মা ব্যাংককে সুদ দিতে হচ্ছে। আর তাদের আয় হচ্ছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার সম্পদ থেকে। ফলে ২০২০ সালে ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
২০২১ সালে জুন পর্যন্ত সময়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার চিত্র দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ১২০ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান হয়েছে পদ্মা ব্যাংকের। যার মধ্যে ৭১ কোটি টাকা নিট সুদের মার্জিন। আর এভাবে লাকসান করতে থাকায় ব্যাংকের মূলধন কমে যাচ্ছে।
জুলাই মাসের ওই চিঠিতে জানানো হয়, ২০১৯ সালে পদ্মা ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারস ইকুইটি ছিল ৪৮৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালে সেটা কমে হয়েছে ৩৩২ কোটি টাকা। আর ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসে তা আরও কমে ২২১ কোটি টাকা হয়।
এভাবে চলতে থাকলে ২০২১ সালের শেষে শেয়ারহোল্ডারস ইকুইটি ১০০ কোটি টাকার নিচে চলে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তার চিঠিতে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের জুন মাসে এসে পদ্মা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১০০ কোটি টাকা।
একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেওয়া হারে মূলধন সংরক্ষণ রাখতে হয়। কোনো ব্যাংক ওই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
এ অবস্থায় ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে সরকারকে দুই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি।
তার প্রথম প্রস্তাব ছিল, পদ্মা ব্যাংকে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের যে আমানত আছে, তার একটি অংশকে ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ শেয়ারে রূপান্তর করা।
ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা রক্ষার জন্য পদ্মা ব্যাংকের দরকার ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু করে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত সাব–অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু করে বাকি ৬০০ কোটি টাকার যোগান পাওয়ার পথ বাৎলেছিলেন তিনি।
চিঠিতে পদ্মা ব্যাংকের এমডি এহসান খসরু বলেছিলেন, পদ্মা ব্যাংককে দ্রুত সময়ে সোনালী, জনতা, অগ্রণী বা রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। এর বাইরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) সঙ্গেও একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলন তিনি।
কিন্তু মূলধন পুনর্গঠন ‘যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ এবং জটিল’ বিষয় হওয়ায় দ্বিতীয় প্রস্তাবে ‘মার্জার বা অ্যাকুইজিশনের’ কথা বলেছিলেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি।
চিঠিতে বলা হয়েছিল, পদ্মা ব্যাংককে ‘অনতিবিলম্বে’ সোনালী, জনতা, অগ্রণী বা রূপালী ব্যাংকের মত অংশীদার কোনো ব্যাংক, কিংবা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) মত কোনো সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা অধিগ্রহণ করা যেতে পারে।
সেই প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক নাকচ করে দেওয়ায় পদ্মা ব্যাংক এখন কী পদক্ষেপ নেবে সে বিষয়ে এহসান খসরুর বক্তব্য জানা যায় নি।