মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) এখন প্রতি মুহূর্তের আর্থিক প্রয়োজনে অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। হাতের মুঠোফোনটিই এখন দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে নগদ টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে। দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এমএফএস সেবার গ্রাহক। সর্বশেষ গত জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে এমএফএস সেবার গ্রাহক প্রায় ১৪ কোটি। যদিও সক্রিয় ব্যবহারকারী পাঁচ কোটির কাছাকাছি। ১২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের দেশে এ সংখ্যা নেহাত কম নয়।
দৈনন্দিন প্রয়োজনে ছোট ছোট লেনদেনে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, বাস, ট্রেন থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মুঠোফোন রিচার্জ, অনুদান প্রদানে অন্যতম মাধ্যম এখন এটি। এখন খুব সহজেই ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে এবং ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেওয়া যাচ্ছে। ফলে মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হিসাব হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে মুঠোফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে ‘বিকাশ’। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে।
ব্যাংকের বাইরে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ চালু হয় ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘নগদ’। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে নগদ চালু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এটির গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক ছাড়পত্র নিয়ে নগদ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন ও গ্রাহকের হিসাব এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যভান্ডারে যুক্ত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি শেষে এ সেবার গ্রাহকসংখ্যা ১০ কোটি ৫ লাখ। জানুয়ারিতে গড়ে দৈনিক লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে নগদের লেনদেনের তথ্য যুক্ত করলে এমএফএস সেবার আওতায় দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। বর্তমানে এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদে দৈনিক গড়ে ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
বর্তমানে নগদের নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ। তবে সক্রিয় গ্রাহক ১ কোটি ৭৫ লাখের কাছাকাছি। ২০১৯ সালের মার্চে চালু হওয়া এই সেবা মাত্র দুই বছরে বাজারের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে। গ্রাহক ও লেনদেনের দিক থেকে নগদ এখন এ খাতের দ্বিতীয় শীর্ষ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। সেবা মাশুল কম হওয়ায় ও সহজে গ্রাহক হওয়ার সুবিধার কারণে অল্প সময়ে বাজার অংশীদারত্ব বাড়াতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে।
নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ বলেন, ‘দুই বছরে আমরা জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে গ্রাহক হিসেবে পেয়েছি। এ সেবার বাজার অংশীদারত্বের ৩০ থেকে ৩২ শতাংশই এখন নগদের। আমরা নগদকে সব ধরনের আর্থিক সেবার সঙ্গে যুক্ত করতে চাই। কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা বিল পরিশোধের পাশাপাশি ঋণ বিতরণ, শেয়ার ব্যবসার মতো সেবাও আমরা চালু করতে চাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পর এসব সেবা চালু করা হবে। ভবিষ্যতে নগদ হবে একটি ডিজিটাল ব্যাংক।’
মোবাইল ব্যাংকিং সেবা যেমন শিল্পপতিদের জন্য সুবিধা করে দিয়েছে, আবার কুরবান আলীর মতো রিকশাচালক ও কম আয়ের মানুষের কাছে বড় আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। কারণ, অনেক শিল্পপতিকে এখন আগের মতো মাস শেষে ব্যাংক থেকে বস্তায় করে টাকা কারখানায় নিতে হয় না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন–ভাতা চলে যাচ্ছে শ্রমিকদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে।
আর রিকশাচালক কুরবান আলী সপ্তাহ শেষে যে টাকা গ্রামের পরিবারের কাছে ঝুঁকি নিয়ে পাঠাতেন, সেই ঝুঁকি শেষ হয়ে এসেছে। কারণ, এখন তিনি দিনে দিনেই টাকা পাঠিয়ে দেন স্ত্রীর মোবাইল ব্যাংক হিসাবে। এ বিষয়ে কুরবান আলী গত মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনেক যাত্রী এখন মোবাইলেই ভাড়া পরিশোধ করেন। এই টাকা আমিও মোবাইলের মাধ্যমে বাড়ি পাঠিয়ে দিই।’
তবে এ সেবার মাশুল এখনো অনেক বেশি। এক হাজার টাকা তুলতে একজন গ্রাহককে খরচ করতে হয় সাড়ে ১৮ টাকা। তবে নগদে এ খরচ ১০ টাকার কম। এ কারণেও নগদে গ্রাহকসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বলে কোম্পানি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দিনে ৫ বারে ৩০ হাজার টাকা জমা করা যায়। মাসে ২৫ বারে জমা করা যায় সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা। আর ১ দিনে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন ও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে পাঠানো যায়। এখন গ্রাহকেরা ঘরে বসে এমএফএস হিসাব খুলতে পারেন। রয়েছে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তরের সুবিধাও।