ডেল্টা লাইফের ৩৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে, সে সাথে আটকে গেল সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে আদিবা রহমানকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ অনুমোদন।
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বৃহস্প্রতিবার (১১ ফেব্রুয়ারী) ভ্যাট আইনে এ মামলা করা হয়। ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মহাপরিচালক জানান, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, ডেল্টা লাইফ টাওয়ার, প্লট-৩৭, রোড-৪৫ (দক্ষিণ) ও ৯০ (উত্তর), গুলশান-২, ঢাকা-১২১২। এর মূসক নিবন্ধন নং: ০০১৩২৩১০৩-০১০১। ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় ভ্যাট গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক সায়মা পারভীনের নেতৃত্বে একটি দল কোম্পানির ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তদন্ত করে। ভ্যাট গোয়েন্দার দল তদন্তের স্বার্থে দলিলাদি দাখিলের জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে তলব করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দাখিলকৃত বার্ষিক প্রতিবেদন, দাখিলপত্র (মূসক-১৯) এবং বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জমাকৃত ট্রেজারি চালানের কপি ও অন্যান্য দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের আড়াআড়ি যাচাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য বিমার ওপর ৪০ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ২১ লাখ ৩৭ হাজার ৪১১ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করেছে। এতে অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৯ কোটি ৮০ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৯ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। এই ফাঁকির ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক দুই শতাংশ হারে ১১ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৮ টাকা সুদ হিসেবে প্রযোজ্য হবে।
তদন্ত অনুসারে নিরীক্ষা মেয়াদে সিএ ফার্মের রিপোর্ট মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটি উৎসে ভ্যাট ছয় কোটি ৩৪ লাখ সাত হাজার ৮০৩ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১১ কোটি তিন লাখ ১৩ হাজার ২৪৯ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ চার কোটি ৬৯ লাখ পাঁচ হাজার ৪৪৬ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়। উৎসে কর্তনের ওপর প্রযোজ্য এই ফাঁকিকৃত ভ্যাটের ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক দুই শতাংশ হারে পাঁচ কোটি ৫৭ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৯ টাকা সুদ আদায়যোগ্য হবে।
অন্যদিকে তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার বিপরীতে এক কোটি ৪৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৮০ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ২০ লাখ ৫৫ হাজার ১০১ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ এক কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার ১২০ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। এই ফাঁকির ওপরও ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক দুই শতাংশ হারে দুই কোটি চার লাখ ৪৬ হাজার ৮৮১ টাকা সুদ টাকা প্রযোজ্য হবে।
তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির সর্বমোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১৬ কোটি ২৪ লাখ ২৭ হাজার ৯০৫ টাকা এবং সুদ বাবদ ১৮ কোটি ৯২ লাখ ৬২ হাজার ৮২৮ টাকাসহ ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৩ টাকা পরিহারের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়।
তদন্তে আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি সরকারের ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে নানা ধরনের জালিয়াতি ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, যা ভ্যাট আইন অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গতকাল এ-সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তদন্তে উদ্ঘাটিত পরিহারকৃত ভ্যাট আদায়ের আইনানুগ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা উত্তরে পাঠানো হবে।
আটকে গেল আদিবা রহমানের নিয়োগ অনুমোদন
এদিকে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে আদিবা রহমান পুনরায় প্রতিষ্ঠানটিতে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ পাচ্ছেন না। গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগের মুখে থাকা ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
গতকাল আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসক হিসেবে চার মাসের জন্য এ নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে নিয়োগ দিয়ে এক চিঠিতে আইডিআরএ বলেছে, ‘বীমা আইন ২০১০ এর ৯৬ ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী প্রশাসক হিসেবে চূড়ান্তভাবে দায়িত্ব গ্রহণের ৪ মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।’
বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ৯৫(৩) এর আলোকে নতুন পলিসি ইস্যু আগের মতো অব্যাহত রাখা এবং কোম্পানির ব্যবসা ও অন্যান্য কার্যক্রম যথারীতি পরিচালনা করতেও বলা হয়েছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনায়।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানির প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মো. শাখাওয়াত নবী, (অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব) এবং মো. রফিকুল ইসলামকে (অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব) পরামর্শক (কনসালটেন্ট) হিসেবে শিগগিরই নিয়োগ দিয়ে কোম্পানির প্রশাসনিক কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
এতে বলা হয়েছে, আপনার (সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা) মাসিক সম্মানী সর্বমোট ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলো। তবে উৎসব ভাতা (যদি থাকে) মোট সম্মানীর ৬০ শতাংশ পাবেন। শিগগিরই সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো দেশি বা বিদেশি অডিট ফার্ম দিয়ে কোম্পানির অডিট সম্পন্ন করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে চিঠিতে। পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে যেকোনো সময়, যেকোনো বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে।
বীমা আইনের ৯৫ ধারার শর্ত মেনেই তাকে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে সুলতান-উল আবেদীন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার চার মাসের জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। কোম্পানিটি দু’টি অডিট ফার্মকে কোনো সহযোগিতা করেনি, এটি গ্রাহক স্বার্থের পরিপন্থী।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও কোম্পানির কার্যক্রম আগের মতোই পরিচালিত হবে। এতে শেয়ারহোল্ডার ও গ্রাহকরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বীমাখাতের বাইরেও অনেক খাতে সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে আসছে। পলিসিহোল্ডারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।’
বিগত কয়েক বছর ধরেই ডেল্টা লাইফের প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি চলে আসছিল। এ জন্য ২০১৯ সাল থেকে কোম্পানিটিতে দু’টি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’টিকে কোন রকম সহযোগিতা করেনি ডেল্টা লাইফ।
দায়িত্ব পেয়ে গতকালই ডেল্টা লাইফের কার্যালয়ে যান সুলতান-উল আবেদিন মোল্লা। এ সময় তিনি কোম্পানিটির সাবেক পরিচালক মঞ্জুরুর রহমান ও সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের কার্যালয়ে তাদের সাথে সাক্ষাত করেন। পরে তিনি কোম্পনিটির বিভাগীয় প্রধানদের সাথে বৈঠক করেন। এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন আইডডিআরএর পরিচালক (উপ-সচিব) মো. শাহ আলম।
উল্লেখ্য, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের পুনরায় মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের আবেদন নাকচ করে আইডিআরএ। বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কায় তার আবেদন নবায়ন করা হয়নি বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলেছে বীমা কোম্পানিটি। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান এবং তার মেয়ে ও কোম্পানিটির সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে মানহানি মামলা করেছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১