দীর্ঘ এক বছর ঋণ আদায়ের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। নতুন করে আর কোনো নির্দেশনা না দিলেও ঋণ আদায়ের ধীরগতি কাটছে না। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংকের খাতায় যেসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে ওই সব ঋণও আদায় হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ঋণের চাহিদা কম থাকায় বর্তমার এর তেমন প্রভাব পড়ছে না। তবে ঋণ পরিশোধে অনীহার উন্নতি না হলে সামনে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।
জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছিল, কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও ওই ঋণকে খেলাপি করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনার সুযোগ ঋণ পরিশোধে অক্ষমদের পাশাপাশি সক্ষমরাও নিয়েছেন। ফলে বিদায়ী বছরে ব্যাংকের নগদ আদায় ব্যাপকভাবে কমে যায়। এ দিকে ঋণ আদায় না হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে সংশ্লিষ্ট ঋণকে খেলাপিও করা যায়নি। অর্থাৎ এসব ঋণ ব্যাংকের খাতায় নিয়মিতই থেকে যায়। আবার যারা ব্যাংকে আমানত রেখেছিলেন, তাদের অনেকেই তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করেন। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক দিকে ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত আসছে না, অন্য দিকে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে।
কয়েকটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, বর্তমানে ঋণ আদায়ের ধীরগতির প্রভাব কিছু ব্যাংক বাদে বেশির ভাগ ব্যাংকেই পড়ছে না। কারণ হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে করোনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ওপর ৫০ শতাংশ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তহবিল জোগান দেয়ার জন্য প্যাকেজ থেকে ব্যবসায়ীদের ১০০ টাকা ঋণ বিতরণ করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫০ টাকার তহবিল পাওয়া যাচ্ছে। অন্য দিকে আমদানি চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে তার একটি অংশ ব্যবহার না হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকার জোগান দিচ্ছে। পাশাপাশি চলমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোও আর আগের মতো ঋণ বিতরণ করছে না। অর্থাৎ অনেকটা দেখে শুনে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এতে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে। সব মিলেই নগদ আদায় কমে যাওয়ার প্রভাব তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কিন্তু সামনে বিনিয়োগ চাহিদা বেড়ে যাবে। আর ব্যাংকগুলোকেও তা বাড়াতেই হবে। কারণ আমানতকারীদের অর্থ বিনিয়োগ না করলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যাবে। পরিচালন ব্যয় মিটিয়ে সুদে আসলে আমানতকারীদের দিন শেষে তা ফেরত দেয়া কষ্টকর হবে। কিন্তু বর্তমানে নগদ আদায় বাড়াতে না পারলে সামনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ হাতে থাকবে না। এ কারণে ঋণ আদায়ের ওপর এখনো জোর দিতে হবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘ এক বছর ঋণ আদায় কার্যক্রম প্রায় থেমে থাকলেও ব্যাংকগুলো এখন ঋণ আদায়ের ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ঋণ আদায় করছেন না। বরং নতুন করে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতি ফিরতে শুরু করেছে। এতে চলতি বিনিয়োগের চাহিদাও বেড়ে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ আদায়ের শিথিলতার ওপর নির্দেশনা দিলে ব্যাংকগুলোর নগদ আদায়ের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ কারণে তারা কোনোভাবেই নগদ আদায়ের শিথিলতার মেয়াদ বাড়ানোর বিপক্ষে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আগামী ২৭ জানুয়ারি গভর্নরের সাথে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে তুলে ধরা হবে বলে একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন।
খেলাপি ঋণের পাশাপাশি নিয়মিত ঋণ আদায়ের গতি শ্লথ হওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতি চালু হওয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। নিয়মিত ঋণ আদায় কমে যাওয়ার এটাই বড় প্রমাণ বলে তারা মনে করেন। নিয়মিত ঋণ আদায় কমে গেলে এসব ঋণ আবার খেলাপি হয়ে যাবে। তাদের মতে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠোর হাতে মনিটরিং করতে হবে। ঋণ আদায়ের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা যথাযথ পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করতে হবে; অন্যথায় খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়বে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। আর মাঝারিরা উঠতে না পারলে বড় উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে না। সব মিলে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় এড়ানো যাবে না। পরিস্থিতি উন্নতি করতে, ব্যাংকারদের ঋণ আদায়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। বিশেষ করে ভালো গ্রাহকদের পুরস্কার বা বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। এটি দেখে মন্দ গ্রাহকও ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসবেন।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১