মুনাফা নির্ণয়ে শেষ মুহূর্তে হিসাব-নিকাশ করছে তফসিলি ব্যাংকগুলো। গতানুগতিক মুনাফা হিসাব নবায়নের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা আরোপ করায় বিদায়ী বছরে যারা ঋণের অর্থ পরিশোধ করেননি, তাদের ঋণের ওপর বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকাররা মুনাফা হিসাবের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কে থাকছেন। তবে যেসব গ্রাহক বিদায়ী বছরে ঋণ পরিশোধ করেছেন, তাদের ঋণের ওপর বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে না। এ কারণে প্রকৃত মুনাফা কিছুটা বাড়বে এ প্রত্যাশা করছেন ব্যাংকাররা।
জানা গেছে, সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব চূড়ান্ত করা হয় ডিসেম্বর শেষে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ স্থগিত রাখার পর মুনাফা আলাদা করা হয়। প্রতিটি ব্যাংক তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে শাখাপ্রধানদের মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা আগেই বেঁধে দেয়া হয়। ওই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অনেক সময় খেলাপি ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আলাদা হিসাবে না রেখে মুনাফা দেখানো হয়। আবার খেলাপি ঋণ কম করে প্রভিশন কম দেখিয়ে বাড়তি মুনাফা দেখানো হয়। শাখাপ্রধানরা ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপকদের কাছে মুনাফার যে তথ্য দেন তাই হিসাবে আনা হয়। এভাবে একটি ব্যাংকের সব শাখার হিসাব সমন্বয় করে মুনাফা চূড়ান্ত করা হয়। এর ওপর নিরীক্ষকদের দিয়ে তা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুনাফা নির্ণয় করা হয়।
কিন্তু এবার গতানুগতিক এ মুনাফার হিসাব করতে পারছেন না ব্যাংকাররা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এক বছর ধরে ঋণ শ্রেণীকরণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শিথিলতা আরোপ করা হয়েছিল; অর্থাৎ কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও ওই গ্রাহককে ঋণখেলাপি করা যাবে না। এ কারণে আগের বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ ছিল, বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর শেষে তা থেকে বাড়ছে না, বরং কমে যাচ্ছে। এক বছর ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণখেলাপি করতে না পারায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ইতোমধ্যে কমে গেছে। খেলাপি ঋণ না বাড়ায় প্রভিশনও কম দেখাতে হবে। এতে ঋণ আদায় না করেও ব্যাংকের মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাবে। এ কৃত্রিম মুনাফা ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ শ্রেণীকরণ না হলে ওই ঋণ থেকে অর্জিত মুনাফা ব্যাংকগুলোর আয় খাতে নিতে কোনো বাধা নেই। অর্থাৎ একটি ঋণ যতক্ষণ পর্যন্ত খেলাপি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংক ওই ঋণ থেকে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিতে পারবে। আর কোনো ঋণখেলাপি হলে ওই ঋণ থেকে অর্জিত সুদ ব্যাংক আয় খাতে নিতে পারে না। এটি আলাদা হিসেবে স্থগিত রাখা হয়। এক বছর ধরে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা আরোপ করায় বেশির ভাগ ব্যাংকের ঋণই আদায় হয়নি। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই ঋণখেলাপিও করা যায়নি। ফলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো অনায়াসে ঋণ আদায় না হলেও বিদ্যমান ঋণ থেকে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিতে পারবে। কৃত্রিম আয় থেকে সরকারের সাড়ে ৩৭ শতাংশ কর পরিশোধ করার পর মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বণ্টন করা হলে ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। এতে যেকোনো ঝুঁকি মোকাবেলায় ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা কমে যাবে।
এ কৃত্রিম মুনাফা ঠেকাতে সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর জন্য জারি করা এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিসহন ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বিনিয়োগ থেকে মুনাফা আয় খাতে নিতে হলে কিছু শর্ত পরিপালন করতে হবে। এর মধ্যে আগে ৩১ ডিসেম্বরে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক যে মুনাফা হিসাব করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতেন সেটিই চূড়ান্ত মুনাফা হিসেবে ধরে নেয়া হতো। কিন্তু গত এক বছর ঋণ আদায় না হওয়ায় কৃত্রিমভাবে যেন কেউ আয় বাড়িয়ে দেখাতে না পারেন সে জন্য ১০ কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগের সুদ আয় খাতে নিতে হলে ব্যাংকের অডিট কমিটিসহ পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। আবার ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার নিচ পর্যন্ত বিনিয়োগ থেকে সুদ আয় খাতে নিতে হলে শাখাপ্রধানের সুপারিশসহ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী থেকে অনুমোদন নিতে হবে। আর ৫ কোটি টাকার নিচে বিনিয়োগ থেকে মুনাফা আয় খাতে নিতে হলে শাখাপ্রধানের সুপারিশসহ তার নিয়ন্ত্রণকারীর কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। অন্য দিকে প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে সুনির্দিষ্ট প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনের বিধান অনুযায়ী আবশ্যিক প্রভিশন হিসাব করে যথারীতি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।
প্রথমে বলা হয়েছিল সব ধরনের ঋণের ওপর বাড়তি ১ শতাংশ জেনারেল প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। পরবর্তীতে তা সুস্পষ্ট করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। বলা হয় যেসব গ্রাহক গেল বছর ঋণ পরিশোধ করেননি শুধু ওই সব ঋণের ওপর বাড়তি ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। যেমনÑ কোনো ব্যাংকের ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে বিদায়ী বছরে এক টাকাও পরিশোধ করা হয়নি এমন ঋণের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা। এই এক হাজার কোটি টাকারও ওপরে নিয়মিত প্রভিশন সংরক্ষণের পাশাপাশি বাড়তি ১ শতাংশ হিসেবে ১০০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এ বাড়তি ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা থেকে বাদ দিয়েই প্রকৃত মুনাফা হিসাব করা হচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এর ফলে প্রকৃত মুনাফা আগের বছরের চেয়ে বাড়ছে না, বরং কমে যাবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চলতি মাসের মধ্যেই হিসাব চূড়ান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সব মিলে আগামী মাসের মধ্যেই শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনুমোদন চাওয়া হবে।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১