ব্যাংকারদের ভাবনায় ২০২১ সন

এম. এ. মাসুম || ২০২১-০১-১৬ ২০:৩৯:৫৯

image

করোনা মহামারির দ্বিতীয় দফা তাণ্ডব চলছে বিশ্বজুড়ে। ফলে প্রথম দফায় যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা দূরের কথা, দ্বিতীয় ঝড় মোকাবেলাই কঠিন হয়ে পড়েছে অনেক দেশের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্যও নতুন বছরের গল্পটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

কোভিড-১৯ মহামারির ছোবলে স্থবির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পড়েছে ব্যাংক খাতে। ব্যাংকাররা বলছেন, মহামারির ফলে এই খাতটিতে ইতোমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে গত এপ্রিল মাসেও তা কল্পনা করা যায়নি।করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিও থমকে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়েছে। তার উপর ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকখাতকে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে।

২০২০ সালের ২৪ ফেব্রয়ারি যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সকল ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ এবং সকল আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ বেধে দিয়ে সার্কুলার জারি করে তার আগেই করোনা মহামারির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছিল সকল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। সার্কুলারে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর আগেই বাংলাদেশে করোন ছড়িয়ে পড়লে ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে অঘোষিত লকডাউন জারি করে সরকার। সকল স্তরের ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ১ এপ্রিল থেকেই নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন করে ব্যাংকগুলো। করোনার বিস্তাররোধে লকডাউনের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। ব্যাংকের ঋণ আদায় প্রায় বন্ধ বললেই চলে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর সুদের আয় প্রায় ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে ।  

একদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা, অন্যদিকে সুদহার হ্রাস,ঋণের কিস্তি আদায়ের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া,চাকুরীর শংকা সব মিলিয়ে ২০২০ সাল জুড়েই বহুমুখী সংকট পার করে দেশের ব্যাংক খাত। এমন সংকট মোকাবেলার কোনও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের কখনোই ছিল না।

মহামারি করোনাভাইরাসের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি অধিকাংশ ব্যাংক। ফলে চলতি বছরের প্রথমার্ধে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নগদ অর্থ সংকটেও পড়তে হয়েছে কিছু ব্যাংককে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে আগের বছরের তুলনায় মুনাফা কমেছে ১৭টির। এছাড়া লোকসানের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে একটি ব্যাংক।

৩১ ডিসেম্বর ২০২০ বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসের আঘাতে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় ধস নেমেছে। এর ফলে বছর জুড়েই ব্যাংকগুলোকে মহামারির চড়া মাশুল দিতে হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা হ্রাস পেয়েছে। অল্প কয়েকটে ব্যাংক মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে যার মধ্যে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি।

করোনার কারণে ২০২০ সালে ঋণগ্রহীতারা ঋণের কিস্তি না দিলেও তাদের ঋণের শ্রেণিমান অবনমন করা যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে নতুন করে কোনো খেলাপি না হওয়ায় ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি কমাতে বিতরণকৃত ঋণের এক শতাংশ অতিরিক্ত সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই অতিরিক্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হলে ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফা থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত আলাদা করে রাখতে হবে। অবশ্য ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নিট মুনাফা কমলেও এ ধরনের সঞ্চিতি ব্যাংকের ভিত্তি মজবুত করতে সহায়তা করবে। ২০২১ সালে ব্যাংক খাতে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, তখন অ্যাসেট কোয়ালিটি ভালো রাখতেও সাহায্য করতে এ সঞ্চিতি।

নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির হাতছানি রয়েছে। ২০২০ সালের প্রতিকূল পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা ২০২১ সালে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে সারা বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। কারণ, মহামারির ধাক্কা সামলে নিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এখনও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা রয়েছে। প্রবাসী আয় দ্রুত গতিতে বাড়ছে। রফতানি আয় বাড়ছে। মেগা প্রকল্পে গতি এসেছে। সংকটে থাকা শেয়ারবাজার এখন প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। ব্যাপক বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত রয়েছে টাকা ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলোও বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেভাবে সরকার ২০২০ সালে অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব মোকাবিলা করেছে, তাতে ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য সমৃদ্ধির বছর। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ২০২০ সালের করোনার আঘাতের পরও দেশের অর্থনীতির যেসব সূচক ভালো অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো ২০২১ সালে আরও শক্তিশালী হবে। আর যেগুলো দুর্বল অবস্থায় আছে, সেসব সূচকও ঘুরে দাঁড়াবে। আগামী জুলাই-আগস্টের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় উল্লম্ফন শুরু হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারীর মধ্যে বাংলাদেশে করোনার ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব হবে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। তবে টিকা কতটুকু কার্যকর তার উপর নির্ভর করছে এর সফলতা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০২১ সালে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার  প্রক্রিয়ায় চালকের আসনে থাকবে ভ্যাকসিন আর বিভিন্ন ধরণের বিনিয়োগ। বিশ্ব অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ২০২১ আমাদের একটি টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে আনবে। তবে স্থানীয়ভাবে ভাইরাসটিকে বশে আনতে হলে ২০২১ সালে দেশের বৃহৎ জনগণকে টিকা দেওয়াই হবে মূল চাবিকাঠি।

নতুন বছরে ব্যাংকারদের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খেলাপি ঋণ আদায়। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক খেলাপিদের প্রতি শিথিল নীতি থাকার কারণে অধিকাংশ কিস্তি আদায় হয়নি। তাই ২০২১ সালে খেলাপি ঋণ আদায় এবং অ্যাসেট কোয়ালিটি ভালো করার জন্য ব্যাংকারদেরকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। এ বছর ঋণ আদায় না হলে তা খেলাপি হয়ে যাবে। আবার গত বছরের খেলাপিও আদায় করতে হবে। তা না হলে খেলাপির পাহাড় তৈরি হয়ে যেতে পারে।

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আত্নর্জাতিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। গত বছর জুড়েই আমদানি-প্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ছিল। নতুন বছরে বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধির গুরুত্ব দিতে হবে।

নতুন বছরের জন্য ব্যাংকাররা অনেক পরিকল্পনাই হয়ত হাতে নিয়েছেন এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশ্ব মানের প্রযুক্তি উন্নয়ন ও এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। মহামারি ব্যাংকগুলোকে শিখিয়েছে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ করতে হবে। নতুন বছরেও ব্যাংক খাতে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হবে। সেসাথে ব্যাংকিং সেবায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। সামনের দিনগুলোতে আর্থিক খাতে বেশকিছু পরিবর্তনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিবর্তনগুলো হতে পারে প্রযুক্তিগত কিংবা প্রক্রিয়াগত। দ্য গ্লোবাল ফিনটেক ইনডেক্স ২০২০-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে বৈশ্বিক প্রতিটি শিল্পের জিডিপির শতকরা ৬০ ভাগ ডিজিটায়িত হবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এ রকমই একটি বহুল প্রচলিত উন্নত প্রযুক্তি হচ্ছে ফিনটেক। আর্থিক খাতের মান উন্নয়নে বাংলাদেশে ফিনটেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসার ও আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে অর্থায়নের বিকল্প মাধ্যম হতে পারে ফ্যাক্টরিং।

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংকের গ্রাহকেরা এখন বেশ সতর্ক। তাঁদের অনেকেই আজকাল ব্যাংকে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিতে বা ওঠাতে চাইছেন না। এ কারণে ব্যাংকগুলো যন্ত্রনির্ভর সেবায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। টাকা জমার জন্য এটিএম তো আগে থেকেই রয়েছে। এখন তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের টাকা জমা নেওয়া ও উত্তোলন-সুবিধা দেওয়ার যন্ত্র ক্যাশ রি-সাইকেলার মেশিন (সিআরএম) স্থাপন করে চলেছে। সম্প্রতি এই যন্ত্র স্থাপন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই যন্ত্রে লেনদেনের পরিমাণও চার গুণের বেশি বেড়েছে।ব্যাংকগুলোর সিআরএম স্থাপন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গ্রাহকদের ব্যাংকে টাকা জমা করতে এখন আর ব্যাংকিং সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। কি রাত কি দিন, যেকোনো সময়ই টাকা লেনদেন করা যাচ্ছে। তাছাড়া,প্রায় সব ব্যাংকই ঘরে বসে হিসাব খোলাসহ নতুন নতুন ডিজিটাল সেবা নিয়ে আসে। নতুন বছরে এধরনের উন্নতমানের প্রযুক্তিগত সেবা আরো বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার মতো বিভিন্ন কাজ একটিমাত্র স্থানে বসেই সেরে ফেলবে। পর্যায়ক্রমে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ হতে পারে ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে।

নতুন বছরে শরীয়াহ ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পরিধি আরো সম্প্রসারিত হতে পারে। দেশে ক্রমেই বাড়ছে ইসলামি অর্থব্যবস্থা। এরই মাঝে বেশ কয়েকটি ব্যাংক সুদের হিসাব-নিকাশ ছেড়ে আগাগোড়া ইসলামি ব্যবস্থা চালু করেছে। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে ইসলামি অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, অর্থনীতিতে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অবদান বাড়ছে। সরকারও এ অর্থব্যবস্থায় ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে। এরই মধ্যে দেশে প্রথমবারের মতো শরিয়াহভিত্তিক সুকুক বন্ড চালু করেছে সরকার। এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে ইসলামী ধারার ব্যাংকের পাশাপাশি কনভেনশনাল (প্রচলিত) ব্যাংকগুলোও। এরই মধ্যে এ বন্ড ছেড়ে চার হাজার কোটি টাকা তুলেছে সরকার। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বন্ড বিক্রি করছে।

দেশে প্রথম শরিয়াহ বন্ড সুকুকের নিলাম সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো। নিলামে ৩৯টি আবেদন জমা পড়ে। আনুপাতিক হারে সবাই বন্ড পায়। ৪ হাজার কোটি টাকার বন্ডের জন্য আবেদন পড়ে ১৫ হাজার ১৫৩ কোটি ১০ লাখ টাকার। এর মধ্যে কনভেনশনাল ব্যাংকগুলো সুকুক বন্ডের ৬৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ ইউনিট কিনে নিয়েছে। অর্থাৎ প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো শরিয়াহভিত্তিক এই বন্ডে বিনিয়োগ করেছে ৩ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ইসলামি ধারায় পরিচালিত ব্যাংক ও কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং ইউনিটগুলো।

এদিকে স্ট্যান্ডার্ড ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক নতুন বছরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং সেবা চালু করছে। নতুন বছরের জানুয়ারি থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারায় ব্যাংকে রূপান্তর করা হলো। আর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ করা হয়।

এ ছাড়া কনভেনশনাল বা সাধারণ ব্যাংকিং করা যমুনা ব্যাংকও ইসলামি ব্যাংকিংয়ে রূপান্তর হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পেয়েছে। ব্যাংক তিনটি পুরোপুরি ইসলামি ধারার কার্যক্রম শুরু করলে দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১১টিতে। ইসলামি ব্যাংকিং চালু করতে আরো ১০টির বেশি আবেদনপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রয়েছে বলে জানা যায়। বাকি কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রতি গুরুত্ব বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত ও বিনিয়োগের দিক থেকে এক চতুর্থাংশই বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দখলে।

ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রথম বাংলাদেশি ব্যাংক হিসেবে সিটি ব্যাংক আন্তর্জাতিক ঋণপত্র ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক অর্থায়ন ব্যবস্থার অধীনে কার্যকর করেছে। জেদ্দা ভিত্তিক ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফিনান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সিটি ব্যাংক লেনদেনটি সম্পন্ন করেছে। এখানে আইটিএফসি অ্যাডভাইসিং ও অর্থায়ন ব্যাংক হিসেবে কাজ করেছে। আইটিএফসি সিটি ব্যাংককে প্রদত্ত মুরাবাহা ট্রেড ফিনান্স লাইনের অধীনে এলসিকে অর্থায়ন করেছে।

২০২০ সনে অধিকাংশ ব্যাংক কাঙ্খিত মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সেকারনে নতুন বছরে ব্যাংকাররা অধিক মুনাফার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। একদিকে অপ্রয়োজনী ব্যয় পরিহার অন্যদিকে সেবার বিভিন্ন প্রোডাক্ট উদ্ভাবনের মাধ্যমে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে চেষ্টা করবে। অধিক সংখ্যক উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং স্থাপনের মাধ্যমে সেবার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা হতে পারে। এর মাধ্যমে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের কাছে সরাসরি ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মানুষের হাতের নাগালে যাচ্ছে সেবা। আর্থিক সেবার আওতায় আসছে শহর থেকে বন্দর, গ্রাম থেকে চরাঞ্চলের মানুষ।মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিং সার্ভিস তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সম্পাদন হয়ে থাকে। কিছু গ্রাহক আছেন যাঁরা সরাসরি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে করতে ইচ্ছুক। উপশাখা অত্যন্ত ব্যয় সাশ্রয়ী ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে। তাই নতুন বছরে উপশাখা অধিকমাত্রায় বিস্তার লাভ করতে পারে। সে সাথে এটিএম বুথের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

আর্থিক অন্তর্ভূক্তি কারর্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে হবে। এখনো দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবার বাইরে আছে। এসব জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিংয়ের আওহায় আনার জন্য পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।

দেশে কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তার সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে প্রণোদনা সহ অন্যান্য ঋণ বিতরণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ দেশের কুটির শিল্প ও এসএমই খাতে এক কোটির বেশি মানুষ কাজ করছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এ খাতের উদ্যোক্তারা।

মোটকথা, নতুন বছরে ব্যাংকারা তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব, সাহস, সেবার মানের আধুনিকায়ন মিশেলে ব্যাংকিং সেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা বাড়াতে চেষ্টা করবেন। সে সাথে ব্যাংকিংকে একটি টেকসই ভিত্তির উপর দাঁড় করাতেও তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। ২০২১ সন ব্যাংকারদের জন্য সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার বছর হোক এটাই প্রত্যাশা।

লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইমেইলঃ ma_masum@yahoo.com

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১