খেলপির ঢল নামতে পারে গার্মেন্টস শিল্পে

ব্যাংকবীমাবিডি || ২০২১-০১-১৬ ০৪:২৭:৪১

image

করোনা মহামারির প্রথম ধাক্কা সরকারি প্রণোদনা সুবিধার বদৌলতে কোনভাবে কাটিয়ে উঠতে পারলেও চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। নতুন রফতানি আদেশ না আসায় কর্মহীন পড়ে আছে পোশাক প্রস্তুতকারক যন্ত্রপাতিগুলো। এই পরিস্থিতিতে নতুন চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে ঋণের কিস্তি। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় যে ঋণ দিয়েছিল তার কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে চলতি জানুয়ারি মাস থেকে। তবে অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা। আর কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিনের মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়বেন অনেক ব্যবসায়ী। এই খেলাপির অভিঘাতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চাপে পড়বে ব্যাংকগুলোও। কারণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এতে ব্যাংকগুলো লোকসানে চলে যেতে পারে। কারণ মুনাফা থেকেই প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার এপ্রিল পর্যন্ত নিম্মমুখী থাকতে পারে। কারণ ইউরোপ-অ্যামেরিকায় এখনও সবার ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি এবং তাদের অর্থনীতিতেও স্থবিরতা কাটেনি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসে রফতানিতে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি। কারণ, দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির অবনতি না হলেও ইউরোপজুড়ে এখনও করোনা তাণ্ডব চলছে। এর আঘাত যদি রফতানি খাতে লাগে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশের অর্থনীতি।

সূত্র মতে, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে, ফলে এই শিল্প দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত।

করোনার সময়ে তৈরি পোশাকের সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে এ খাতের শ্রমিকের আয়ের ওপরও। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এ খাতের শ্রমিকদের গড়ে আয় কমেছে ৮ শতাংশ। এর ফলে ৫৮ শতাংশ শ্রমিকের আর্থিক চাপ আগের তুলনায় বেড়েছে। আয় কমে যাওয়ায় ৮২ শতাংশ শ্রমিকের দৈনিক খাবার গ্রহণও অতীতের তুলনায় কমে গেছে। শুধু তাই নয়, এই সময়ে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের হয়রানিও বেড়েছে ১৭ শতাংশ।

শনিবার ‘রিকভারি অব দ্য অ্যাপারেল সেক্টর ফ্রম দ্য কোভিড-১৯ ক্রাইসিস : ইজ অ্যা ভ্যালু চেইন বেসড পসিবল?’ শীর্ষক সংলাপে আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিডি ঐ জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনিশ। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ওপর জরিপকাজটি চালানো হয়। যৌথভাবে জরিপকাজটি পরিচালনা করে সিপিডি ও পলিসি স্টাডিজ অব শ্রীলঙ্কা। জরিপের বিস্তারিত তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

জরিপে করোনার এই সময়ে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে তুলনামূলক চিত্র দেখানো হয়। এতে দেখা যায় বেশকিছু ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে করোনা শুরু হওয়ার পর তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের চাকরি হারানো নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, বর্তমান সময়ে এসে ঐ অনিশ্চয়তা অনেকটাই কমেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ৩৬ শতাংশ শ্রমিক তাদের চাকরি নিয়ে খুবই অনিশ্চয়তায় ছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই চরম অনিশ্চয়তা চার শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও শ্রীলঙ্কায় এই অনিশ্চয়তা কমেনি, বরং কিছুটা বেড়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনা মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা ঢালাও ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে। পরবর্তী সময়ে এর বেশির ভাগই ফিরে এলেও দর কমেছে। এছাড়া এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকার সহায়তা দিলেও শ্রমিক ছাঁটাই ও লে অফের মতো ঘটনা ঘটেছে। এমনকি এখনো নিরবে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। আবার অনেক কারখানা নতুন নিয়োগও দিচ্ছে।

এ সময় বলা হয়, গত বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৪ দশমিক ৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও চলতি বছর ঘুরে দাঁড়াবে। এটি ইতিবাচকভাবে ঘুরে প্রায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। তবে তা সত্ত্বেও কর্মসংস্থান বাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলবে না।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী সম্মিলিতভাবে এ সংকট মোকাবিলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গার্মেন্টস খাতের ওপর চাপ এলে শ্রমিকদের বিপদ বাড়বে। তাদের অস্তিত্বও প্রশ্নের মুখে পড়বে। সরকার আবারও প্রণোদনা দেবে—এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, সময় বাড়াবে (ঋণের সুদ পরিশোধের)—সে চিন্তা হচ্ছে।

দেশে করোনা প্রকোপের শুরুর দিকে বিজিএমইএ জানিয়েছিল, করোনার কারণে প্রায় ৩২৫ কোটি ডলরের রফতানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এসব কারণে কম পুঁজির অনেক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধও হয়ে গেছে। আর বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামীতে আরো বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাতে তৈরি পোশাক রফতানি কমে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের’ জানুয়ারি সংখ্যায় এই ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় আমরা বিপর্যস্ত। করোনার টিকার প্রাপ্যতা এখনও নিশ্চিত হয়নি। আমাদের শঙ্কা, পোশাক রফতানির নিম্নমুখী প্রবণতা আগামী এপ্রিল পর্যন্ত থাকতে পারে।

তিনি বলেন, মহামারীর ধাক্কা থেকে শিল্প রক্ষায় সরকার পোশাক কারখানা মালিকদের স্বল্প সুদের যে ঋণ দিয়েছিল, তা পরিশোধে ছাড় চেয়ে ইতোমধ্যে একটি খোলা চিঠি দেয়া হয়েছে। শ্রমিকের বেতন বাবদ সরকার পোশাক খাতকে যে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ দিয়েছিল; আট মাসের গ্রেড পিরিয়ড শেষে জানুয়ারি থেকেই তা পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা। চিঠিতে সেই টাকা পরিশোধের সময় আরও ছয় মাস বাড়ানো অথবা প্রণোদনা পরিশোধের মেয়াদ আরও অতিরিক্ত ১ বছর স¤প্রসারিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ি বলেন, আগামীতে আগের মতো অর্ডার আসলেও সমস্যাটা হবে প্রণোদনার ঋণ পরিশোধ নিয়ে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে অধিকাংশ কারখানা অচল হয়ে পড়বে। কারণ ফুলস্কেলে গেলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লাগবে, সেটা থেকে যদি তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে সেটা তার জন্য যথেষ্ট হবে না।

এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৫৫৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তিন শতাংশ কম।

এদিকে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ আগামি আগস্টের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা দেখছেন না। আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা আগের চেয়েও বেশি উদ্বেগের। তিনি বলেন, ইউকে, জার্মান, ফ্রান্সের অবস্থা খারাপ। আমেরিকার অবস্থাও ভাল না। আমাদের যেহেতু ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের জিনিসপত্র, বড়দিনের বিক্রিও খারাপ হয়েছে। বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়েছে ওদের। প্রথম ঢেউয়ে কিন্তু এতটা ছিল না, এখন অবস্থা খুবই খারাপ। সবাই টার্গেট করেছিল, ক্রিসমাসে ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

বিসিআই সভাপতি বলেন, নিটে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অর্ডার আসছে। আর উভেন সেক্টরে সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের মতো অর্ডার আসছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর রফতানিতে ধস নামায় পোশাক খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের ছয় মাসের (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য স্বল্প সুদে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয় সরকার। চলতি জানুয়ারি মাস থেকে ওই ঋণ পরিশোধে ২৪ মাসের কিস্তি শুরু হওয়ার কথা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক চিঠিতে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১