একটি ব্যাংকে যত টাকা থাকে, তার মাত্র ১০ শতাংশের মতো ব্যাংকের উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের। বাকি ৯০ শতাংশ সাধারণ জনগণের। অথচ সাধারণ জনগণ বা আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে তেমন সুবিধা পান না। সব সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন ব্যাংকের পরিচালকেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী ব্যাংকের পরিচালকেরা নিজ ব্যাংক থেকে তাদের মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারেন না। তবে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কোটা শেষ হয়ে গেলে তখন ভিন্ন পথের আশ্রয় নেন ব্যাংক পরিচালকেরা। কখনো বেনামে আবার কখনো অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তারা। অন্যদিকে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য কোনো সীমা না থাকায় সেটাকে কাজে লাগান তারা। এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণ নেন। এতে ঋণ পাওয়ার উপযোগী সাধারণ গ্রাহকেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। বছরের পর বছর ধরে এমন ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, পরিচালকেরা এখন শুধু ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, এর পাশাপাশি তারা সিএসআরের (করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) টাকায়ও ভাগ বসাচ্ছেন। নিজেদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে সিএসআরের টাকা নিয়ে নিচ্ছেন। আর ব্যাংক সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজ পেতে ভেন্ডর ও থার্ড পার্টি হিসেবে একাধিক কোম্পানি খুলেছেন অনেকে। ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছেন। টাকার বিনিময়ে অনেককে চাকরি দিচ্ছেন পরিচালক। এছাড়া ঋণ মঞ্জুর, সুদ মওকুফ ও ঋণ পুনঃতপশিলের ক্ষেত্রেও নানা সুবিধা নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এ ঋণ যাতে আর ফেরত দিতে না হয়, তার সব ধরনের বন্দোবস্ত করেছেন তারা। তাদের ঋণ খলাপি হওয়ার আগেই পুনর্গঠন করা হয়, যে কারণে ঋণখেলাপির তালিকায় তাদের নামও আসে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঋণ নেওয়ার জন্য আবেদন করতে চাপ দেয়। আর সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মঞ্জুর হওয়া ঋণের টাকা নিয়ে নেন ব্যাংকের প্রভাবশালী অনেক পরিচালক। এভাবে ব্যবসায়ীদের কৌশলে ঠকান ব্যাংকের পরিচালকেরা।
গত বছর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের ঋণের তথ্য তুলে ধরেন। সেখানে দেখা যায় যে, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ হওয়া ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। এটা অবশ্য ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত তথ্য। সেই সময়ের তথ্যে দেখা যায়, অন্য ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক থেকে। অন্য ব্যাংকের পরিচালকেরা ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১৯ হাজার ১৭৫ কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং এক্সিম ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ১০ হাজার ৫১৩ কোটি ৬৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে পাবে ১০ হাজার ১২৬ কোটি ৭২ লাখ ৫ হাজার টাকা। পূবালী ব্যাংক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে পাবে ৯ হাজার ৭৩৫ কোটি ৫২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
তথ্যমতে, পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬১৪ কোটি ৭৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংক পরিচালকের বিরুদ্ধে বেনামে প্রচুর ঋণ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকের পরিচালকদের অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়ার কারণে এ ধরনের কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছেন তারা। তাদের মতে, একই পরিবার থেকে দুই জনের পরিবর্তে চার জন পর্যন্ত পরিচালক রাখার বিধান, পরিচালকের মেয়াদ পরপর দুই বারে সর্বোচ্চ ছয় বছরের পরিবর্তে পরপর তিন বারে সর্বোচ্চ ৯ বছর করার বিধান এবং একই পরিবারের চার সদস্যের বাইরে অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ রাখায় ব্যাংক পরিচালকদের ক্ষমতা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এতে হয়তো আইন রক্ষা হচ্ছে, কিন্তু এটা দেশের জন্য কোনোভাবেই ভালো নয়। আগেও মাঝে মাঝে এমন ঘটত। এটা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে না। আমি যখন ডেপুটি গভর্নর ছিলাম, তখন ৩৪ জন বোর্ড সদস্যকে এমন কাজের জন্য বোর্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, যে হিসাব পাওয়া যায়, সে অনুযায়ী এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালকেরা নিয়েছেন ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে। এ টাকা যদি জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা যেত, তাহলে অনেক উপকার পাওয়া যেত। অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা করতে পারতেন। অনেকে তাদের ব্যবসা বাড়াতে পারতেন।
কয়েক মাস আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ব্যাংকিং খাতবিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংকগুলো যে জনগণের আমানতে পরিচালিত হয়, এই বাস্তবতা দিনে দিনে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। জনগণের আমানত কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হচ্ছে এবং খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, তথাকথিত ব্যাংক মালিক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার—এই তিন পক্ষই জনগণের আমানতের কথা ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী ও ঋণখেলাপিদের সুযোগ করে দিচ্ছে। সরকার অনেক সময় ঋণখেলাপি, অর্থ আত্মসাৎকারী ও জালিয়াতদের সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করছে। অনেক সময় মনে হচ্ছে সরকার তাদের কাছে জিম্মি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন ও নীতিমালা এমনিতেই দুর্বল। সরকার আরো দুর্বল করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি, যা একাধিকবার পুনর্গঠিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে আবার খেলাপি হলেও তিনি কখনোই খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হন না। সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক।
অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com
ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১