যত চাপ বেসরকারী ব্যাংকারদের

এম. এ. মাসুম || ২০২০-১২-২৪ ১১:২১:৫০

image

অনেক দিন ধরেই স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না ব্যাংকিং খাতের বিশেষ করে বেসকরারী ব্যাংকের। মহামারি করোনাভাইরাসের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি অধিকাংশ ব্যাংক। ফলে চলতি বছরের প্রথমার্ধে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নগদ অর্থ সংকটেও পড়তে হয়েছে কিছু ব্যাংককে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে দফায় দফায় পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়াসহ নানা কারণে বেশ চাপে ছিল ব্যাংকগুলো। সুদ হারের নয়-ছয় চালুর পর এই চাপ বেড়েছে। এখন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে এপ্রিল ও মে মাসের সুদ স্থগিত (ব্লক) রাখার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়,এপ্রিল ও মে এই দুই মাসের সুদ বা আরোপযোগ্য সুদ/মুনাফা ‘সুদবিহীন ব্লকড হিসাবে’ স্থানান্তর করতে হবে। ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, আগামী জুন পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণিমানে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। এর ফলে কোনো ঋণগ্রহীতা যদি ৩০ জুন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন,তাহলে তাঁকে খেলাপি করা যাবে না। তবে যদি কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতা এই সময়ের মধ্যে ঋণ শোধ করেন, তাঁকে নিয়মিত ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে।

সব মিলিয়ে বিশাল বোঝার চাপ সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংক খাতের ওপর। ভার বহন করার সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর আদৌ আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। অন্যদিকে গত ৩ মাসে ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লেও কাগজে-কলমে তা কম দেখানো হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। অন্যদিকে, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে গিয়েও ব্যাংকগুলো বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে ব্যাংকগুলো এই খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহী হবে না। এতে করে এসএমই উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববাণিজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের কারণে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে অনেক ঋণগ্রহীতাই সময়মতো ঋণের অর্থ পরিশোধে সক্ষম হবেন না বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এতে চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এবং দেশে সামগ্রিক কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে—এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট (এক অঙ্ক) কার্যকর করেছে ১ এপ্রিল থেকে। সব ধরনের ঋণ ও বিনিয়োগের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। গ্রাহক কোনো কারণে খেলাপি হলে ওই সময়ের জন্য ঋণের স্থিতি বা কিস্তির বিপরীতে ৯ শতাংশের বাইরে অতিরিক্ত আরও ২ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ করা যাবে। এর বাইরে ঋণের বিপরীতে অন্য কোনো সুদ বা মুনাফা আরোপ করা যাবে না। তবে রফতানির ঋণের সুদের হার ৭ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকছে। আর ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে দেয়া ঋণের সুদহার এর আওতায় আসবে না।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের সুদ হারের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। ফলে ব্যাংকগুলো বাস্তবতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করতে পারবে। ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার বেধে দিলেও সর্বনিম্ন সুদের হারের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সুদের হার ৯ শতাংশের চেয়ে কম আদায় করতে পারবে।

ইতোপূর্বে ঋণখেলাপিদের নিয়মিত হওয়ার বড় ধরনর সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন খেলাপিরা। এতে সুদ হার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। আর এক বছরের ঋণ পরিশোধে বিরতিসহ ১০ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধ করতে পারবেন। আবার ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণও নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রথম এক বছর কোনও কিস্তি দিতে হবে না গ্রাহকদের। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে খেলাপী ঋণকে দীর্ঘ মেয়াদী করা হল। ব্যাংকগুলো এ ধরনেরে ঋণের টাকা ভবিষ্যতে আদৌ ফেরত পাবে কিনা সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের এধরনের সুবিধা দেয়ার ফলে সাময়িকভাবে ঋণ খেলাপি কম দেখা গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে খেলাপির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতি পুনরূদ্ধারে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপি না করা সহ বেশকিছু সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামর্থ্যবানরাও ঋণের কিস্তি ফেরত দিচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে।

কভিড-১৯ মহামারীর আঘাতে বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। স্থবিরতা বিরাজ করছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, যার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর। ঋণ বিতরণ যেমন প্রায় বন্ধ, আদায়ও শূন্য। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমবে, এটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু জুন শেষে দেখা যাচ্ছে, ধারণার চেয়েও বড় ধস নেমেছে পরিচালন মুনাফায়। দেশের প্রায় সবক’টি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে, বেশির ভাগ ব্যাংকেরই মুনাফা কমেছে ২৫ শতাংশের বেশি।

সব মিলিয়ে মারাত্নক চাপে আছেন ব্যাংকাররা বিশেষ করে বেসরকারী ব্যাংকাররা। সরকারী ব্যাংকের মুনাফা কমলেও তাদের কর্মীদের চাকরী নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বেসরকরী ব্যাংকের মুনাফার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বেসকারকারী ব্যাংকারদের বেতন এবং চাকুরীর উপর। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মীদের বেতন ১০-২০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে, ছাঁটাইও করা হয়েছে কয়েক শত ব্যাংক কর্মীদেরকে, বার্ষিক বেতন প্রবৃদ্ধি বন্ধ রয়েছে। এখনো অনেক বেসকারী ব্যাংকে গোপনে ছাঁটাই অব্যাহত থাকার কথাও শুনা যায়। যারা চাকরীরত আছেন তারাও অস্তিত্ব রক্ষায় মারাত্মক চাপে আছেন।

বর্তমানে ব্যাংকিং কার্যক্রম আগের মত স্বাভাবিক করা হয়েছে। কিন্তু দেশের সার্বিক ব্যাবসা বাণিজ্যে এখনো গতিশীল হয়নি। বছর শেষে ব্যাংকগুলোর মুনাফা ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ব্যাংকাররা। বেসকারী ব্যাংক কর্মীদের অস্তিত্ব রক্ষার চাপ কতদিন অব্যাহত থাকবে তা নিয়েই শংকায় আছেন তারা।

 

অফিস : দক্ষিণ বনস্রী, ঢাকা। ই-মেইলঃ bankbimabd@gmail.com, editor.bankbimabd@gmail.com

ফোন: +৮৮০১৭১৮৬২১৫৯১